অশ্বমেধ যজ্ঞ কি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

21 June, 2020

অশ্বমেধ যজ্ঞ কি

অশ্বমেধ যজ্ঞ কি
“রাষ্ট্রমশ্বমেধো জ্যোতিরেব তদ্রাষ্ট্রে দধাতি। ক্ষত্রায়ৈব তদ্বিশং কৃতানকরামনুবর্তমানং করোতি।। অথো ক্ষত্রং বা অশ্বঃ ক্ষত্রস্যৈতদ্রূপং য়দ্ধিরণ্যং। ক্ষত্রমেব তৎ ক্ষত্রেণ সমর্ধয়তি। বিশমেব তদ্বিশা সমর্ধয়তি।।” শতপথ ১৩।২।২।১৬,১৫,১৭,১৯
অর্থাৎ যা দ্বারা রাজ্যের প্রকাশ বা উন্নতি হয় তাই অশ্বমেধ। রাজ্যের উন্নতিবাচক কর্ম ধারণ করাই রাজ্যসভার কার্য। ঐ রাজ্যসভা নিজ পক্ষ থেকেই প্রজার প্রতি কর ধার্য করে থাকে। সেই রাজা দ্বারাই রাজ্য ও প্রজা দ্বারাই প্রজাদের বৃদ্ধি বা উন্নতি হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি অশ্বমেধ হচ্ছে সেই কর্ম যা দ্বারা দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়ে থাকে। এখানে অশ্লীলতার কোনো স্থান নেই। তাই বলতে পারি যারা এই মহৎ কর্মের বিকৃত অশ্লীল অর্থ করেছে সেসব অল্পবুদ্ধি ভাষ্যকারদের সেই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ রূপে কল্পনা প্রসূত, যার কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই।
" অধ্বর ইতি যজ্ঞনাম- ধ্বরতি হিংসাকর্মা তৎ প্রতিষেধঃ"
-------নিরূক্ত ২ঃ৭
অর্থাৎঃ যজ্ঞের নাম অধ্বর যার অর্থ হিংসারহিত কর্ম।
প্রণাম জানাই 🙏মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীকে, যিনি প্রথম বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বচনের প্রমাণ দ্বারা মহীধর ও উব্বটের সেই বানানো বিকৃত অনুবাদের খণ্ডন করেছিলেন।উব্বট-মহীধরের ভাষ্য অনুযায়ী অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্ব হত্যা করা হয় এবং পরবর্তীতে রাণী অশ্লীল কর্মে লিপ্ত হয়। আসুন দেখে নেই যজ্ঞ কি?বৈদিক সংস্কৃতের ধাতুপাঠ অনুযায়ী যজ্ঞ শব্দের উৎপত্তি ‘যজ্’ ধাতু হতে, যার অর্থ- ১) দেব পূজা ২) সংগতিকরণ বা ঐক্যবদ্ধ করা ৩) দান করা মহর্ষি যাস্কাচার্য তাঁর অমরগ্রন্থ নিরুক্তে লিখেছেন-অধ্বর ইতি যজ্ঞনাম। ধ্বর ইতি হিংসাকর্মা তৎপ্রতিনিষেধ।। নিরুক্ত ২.৭ অর্থাৎ যজ্ঞের এক নাম অধ্বর। ধ্বর দ্বারা হিংসা কর্ম বোঝায়। অধ্বর শব্দ প্রয়োগে সেই হিংসা কর্ম নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ যজ্ঞে পশুবলি নিষিদ্ধ। চারবেদের অসংখ্য স্থানে যজ্ঞকে অধ্বর বলা হয়েছে। তাই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, যেসব ব্যক্তি বেদের যজ্ঞকে পশুবলির অনুষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছে তাদের সেই ব্যাখ্যা ভুল এবং বেদ বিরুদ্ধ।
এবার দেখে নেই অশ্বমেধ যজ্ঞ কী- যজুর্বেদের ব্যখ্যা ব্রাহ্মণ গ্রন্থ হচ্ছে শতপথ ব্রাহ্মণ। শতপথের ১৩।২।২।১৪,১৫,১৭ এবং ১৯ এ বলা হয়েছে “প্রজাপতির্বৈ জমদগ্নিঃ সো অশ্বমেধঃ। ক্ষত্রং বাশ্বো বিডিতরে পশবঃ। ক্ষত্রস্যৈতদ্রূপং য়দ্ধিরণ্যং। জ্যোতির্বৈ হিরণ্যম্।”অর্থাৎ রাজ্যপলনের কর্মই অশ্বমেধ। রাজার নাম অশ্ব এবং প্রজার নাম অশ্ব ব্যতীত অপরাপর পশুর নাম।অশ্বমেধে রাজ্যের শোভা স্বরূপ ধন হয়ে থাকে এবং সেই জ্যোতির নাম হিরণ্য। শতপথ ব্রাহ্মণের ১৩।১।৬ এ বলা হয়েছে- “রাষ্ট্রং বা অশ্বমেধঃ। বীর্য়ং বা অশ্বঃ।” অর্থাৎ অশ্ব শব্দ বল বাচক। যে কর্মে রাজ্যের প্রজাদের বল বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটে তাই অশ্বমেধ। "অশ্ব" শব্দটির বহু অর্থ হয়।
যেমন ইন্দ্র (তীক্ষ্ম বিদ্যুত তরঙ্গ) এর এক অপর নাম অশ্ব।"ইন্দ্র বৈ অশ্ব"- কৌশিক ব্রাহ্মণ ১৫.৪  "সঃ আদিত্য রশ্মি অপি গৌর উচ্চৈতে" - নিরুক্ত ২।৬
সেই সূর্যের কিরণকেও গো বলা হয়।
রাজসুয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ। অকাশ্বমেধাবৃচ্ছিষ্টে জীব বর্হিমমন্দিতমঃ।। (অথর্ববেদ ১১।৭।৭) . রাজসূয়, বাজপেয়,অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ আদি সব যজ্ঞ অধ্বরঃ অর্থাৎ হিংসা রহিত যজ্ঞ। যাহা প্রাণীমাত্রকে বৃদ্ধি এবং সুখ শান্তি দাতা। . এই মন্ত্রে রাজসূয় আদি সব যজ্ঞকে অধ্বরঃ বলে গিয়েছেন। যার একমাত্র সর্ব্বসম্মত অর্থ হিংসা রহিত যজ্ঞ। . তাহলে ইহা স্পষ্ট যে, বেদের মধ্যে কোন যজ্ঞে পশুবধের আজ্ঞা নেই। যা বেদবিহিতা হিংসা নিয়তাস্মিংশ্চরাচরে। অহিংসামেব তাং বিদ্যাদ্বেদাদ ধর্মো হি নির্ব্বভৌ।। যো হিংসকানি ভুতানি হিনস্ত্যান্তসুখেচ্ছয়া। স জীবংশ্চ মৃতশ্চৈব, নকশ্চিক সুখমেধতে।। (মনুস্মৃতি ৫।৪৪- ৪৫) . অর্থাৎ বেদে বিশ্ব সংসার মধ্যে দুষ্ট আততায়ী, ক্রুর পাপীকে দন্ড দান রূপ হিংসা বিহিত আছে তাহা অহিংসাই জানবে। কারন বেদ দ্বারাই যথার্থ ধর্মের প্রকাশ হয়।
ন মাংসমশ্নয়াৎ, ন মিথুনমুপোয়াৎ য়ন্মাংসমস্নীয়াৎ,য়ন্মিথুনমুপেয়াদিতি ন ত্বৈবেষা দীক্ষা।।শ০ ব্রা০ ৬।২।২।৩৯
অর্থাৎ মাংসভক্ষণ ও মিথুন করবে না কেননা মাংসভক্ষণ ও মিথুন করলে তার দীক্ষাই শেষ হয়ে যায়।।
অথর্ববেদে ঈশ্বর আদেশ দিয়েছেন..
যঃ পৌরষেযেণ ক্রবিষাং সমঙ্কতে যো অশ্বয়েন পশুনাং যতুধান।
যো অঘ্ন্যায় ভরতি ক্ষীরমগ্নে তেষাং শীর্ষাণি হরসাপি বৃশ্চ।।
(অথর্ববেদ ৮।৩।১৫)
- যে দুঃখদায়ী জীব পুরুষ বধ দ্বারা প্রাপ্ত মাংস দ্বারা যে ঘোড়ার মাংস এবং পশু দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে এবং যে হত্যার অযোগ্য গাভীর দুধকে নষ্ট করে হে অগ্নি তাহার শির কে নিজের বল দ্বারা ছিন্ন করো।
অথচ যে অশ্ব রাজ্য জয় করে ফেরে তাকে হত্যা করার বিধান কি রূপে বলা থাকে। বেদের কিছু মন্ত্রের রূঢ় অর্থ করার ফলে এরূপ দৃশ্য হয়।

ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুং কনিকদং বাজিনং বাজিনেষু।।
(যজুর্বেদ ১৩।৪৮)
- হে পুরুষ এই হর্ষ ধ্বনিকারক এক ক্ষুর বিশিষ্ট বেগবান অশ্বকে মেরো না।
.
" একশফো বা এষ পশুর্যদশ্চ; তং মা হিংসীরিতি"
(শতপথঃ ৭।৫।২।৩৩)
- ইহার অভিপ্রায় এই যে, একশফ শব্দ দ্বারা অশ্বের গ্রহন হয়ে থাকে। এইজন্য একশফ পশু অশ্বকে তুমি হিংসা করো না।
.
যে অর্বন্ত জিঘাংসতি তমজ্যসীতি বরুণঃ পরো মর্তঃ পরঃশ্ব।।
(যজুর্বেদ ২২।৫)
-যে মনুষ্য অশ্বকে হত্যার ইচ্ছা করে হে বরুণ তাকে শাস্তি প্রদান করো।
.
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা।।
(অথর্বেদ ১।১৬।৪)
- যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।
.
"অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।
.
রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ।
অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট জীবর্বহিভমদিন্তম।।
(অথর্ববেদ ১১।৭।৭)
- রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অতন্ত্য হর্ষদায়ক।
.
বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইহা স্পষ্ট যে, অশ্ব কে বধ করা সর্বদা নিষিদ্ধ এবং কেউ যদি বধের চেষ্টা করে তবে তাকে শাস্তির বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। রাজসুয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ আদিকে অধ্বর বলা হয়েছে অর্থাৎ যাতে হিংসা না হয়। অতএব সায়ন এবং রমেশের ভাষ্য বেদের সাংঘর্ষিক তথা অসংগত। উক্ত মন্ত্রের সুনির্মল অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বের করেছেন। পাঠকদের জন্য তারই উপস্থাপন করা হলো -
.
যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানদভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি।
মা তদ্ভূম্যামাশ্রিষন্মা তৃণেষু দেবেভ্যস্তদুশদভ্যো রাতমস্তু।।
(ঋগবেদ ১।১৬২।১১)
.
পদার্থঃ হে বিদ্বান! (নিহতস্য)নিরন্তর চলময়মান [নি পূর্বক হন ধাতুর অর্থে, হন= গতি ] (তে) তোমার (অগ্নিনা) ক্রোধাগ্নি দ্বারা (পচ্যয়মানাত্) তপ্ত হয়ে (গাত্রাত্) শরীর থেকে বা হাত থেকে (যত্) যে অস্ত্র (অভিশূলম) লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] (অবধাবতি) ধাবিত হয় (তত্) ইহা (ভূম্যাম) ভূমির মধ্যে ( মা, আ, শ্রিষত) পড়ে না থাকে (তৃণেষু) ঘাসআদির মধ্যে থাকে।( উশদম্ভঃ) আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী (দেবেভ্য) গুণবান দের জন্য (রাতম অস্ত) অর্পনকৃত হোক।
.
সরলার্থঃ হে বিদ্বান! নিরন্তর চলময়মান তোমার ক্রোধাগ্নি দ্বারা তপ্ত হয়ে শরীর থেকে বা হাত থেকে যে অস্ত্র লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] ধাবিত হয় ইহা ভূমির মধ্যে পড়ে না থাকে ঘাসআদির মধ্যে না থাকে। আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী গুণবান দের জন্য অর্পনকৃত হোক।
দুষ্টকে দন্ড প্রদান করা হিংসা নয় পরন্ত অহিংসারূপ পূণ্য তাহা মনুস্মৃতি ৮।৩৫১ এ স্পষ্ট আছে- . " নাততায়িবধে দোষো হন্তুর্ভবতি কশ্চন" অর্থাৎ আততায়ি ( যে ব্যক্তি বধ উদ্যত) তাহাকে বধ করিলে কোন দোষ নেই।
যঃ পৌরষেযেণ ক্রবিষাং সমঙ্কতে যো অশ্বয়েন পশুনাং যতুধান।
যো অঘ্ন্যায় ভরতি ক্ষীরমগ্নে তেষাং শীর্ষাণি হরসাপি বৃশ্চ।।
(অথর্ববেদ ৮।৩।১৫)
- যে দুঃখদায়ী জীব পুরুষ বধ দ্বারা প্রাপ্ত মাংস দ্বারা যে ঘোড়ার মাংস এবং পশু দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করে এবং যে হত্যার অযোগ্য গাভীর দুধকে নষ্ট করে হে অগ্নি তাহার শির কে নিজের বল দ্বারা ছিন্ন করো।

ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুং কনিকদং বাজিনং বাজিনেষু।।
(যজুর্বেদ ১৩।৪৮)
- হে পুরুষ এই হর্ষ ধ্বনিকারক এক ক্ষুর বিশিষ্ট বেগবান অশ্বকে মেরো না।

" একশফো বা এষ পশুর্যদশ্চ; তং মা হিংসীরিতি"
(শতপথঃ ৭।৫।২।৩৩)
- ইহার অভিপ্রায় এই যে, একশফ শব্দ দ্বারা অশ্বের গ্রহন হয়ে থাকে। এইজন্য একশফ পশু অশ্বকে তুমি হিংসা করো না।

যে অর্বন্ত জিঘাংসতি তমজ্যসীতি বরুণঃ পরো মর্তঃ পরঃশ্ব।।
(যজুর্বেদ ২২।৫)
-যে মনুষ্য অশ্বকে হত্যার ইচ্ছা করে হে বরুণ তাকে শাস্তি প্রদান করো।

যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা।।
(অথর্বেদ ১।১৬।৪)
- যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।

"অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।

রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ।
অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট জীবর্বহিভমদিন্তম।।
(অথর্ববেদ ১১।৭।৭)
- রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর অর্থাৎ হিংসারহিত। অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অতন্ত্য হর্ষদায়ক।
.
বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইহা স্পষ্ট যে, অশ্ব কে বধ করা সর্বদা নিষিদ্ধ এবং কেউ যদি বধের চেষ্টা করে তবে তাকে শাস্তির বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। রাজসুয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ আদিকে অধ্বর বলা হয়েছে অর্থাৎ যাতে হিংসা না হয়। অতএব সায়ন এবং রমেশের ভাষ্য বেদের সাংঘর্ষিক তথা অসংগত। উক্ত মন্ত্রের সুনির্মল অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বের করেছেন। পাঠকদের জন্য তারই উপস্থাপন করা হলো -
.
যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানদভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি।
মা তদ্ভূম্যামাশ্রিষন্মা তৃণেষু দেবেভ্যস্তদুশদভ্যো রাতমস্তু।।
(ঋগবেদ ১।১৬২।১১)
.
পদার্থঃ হে বিদ্বান! (নিহতস্য)নিরন্তর চলময়মান [নি পূর্বক হন ধাতুর অর্থে, হন= গতি ] (তে) তোমার (অগ্নিনা) ক্রোধাগ্নি দ্বারা (পচ্যয়মানাত্) তপ্ত হয়ে (গাত্রাত্) শরীর থেকে বা হাত থেকে (যত্) যে অস্ত্র (অভিশূলম) লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] (অবধাবতি) ধাবিত হয় (তত্) ইহা (ভূম্যাম) ভূমির মধ্যে ( মা, আ, শ্রিষত) পড়ে না থাকে (তৃণেষু) ঘাসআদির মধ্যে থাকে।( উশদম্ভঃ) আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী (দেবেভ্য) গুণবান দের জন্য (রাতম অস্ত) অর্পনকৃত হোক।
.
সরলার্থঃ হে বিদ্বান! নিরন্তর চলময়মান তোমার ক্রোধাগ্নি দ্বারা তপ্ত হয়ে শরীর থেকে বা হাত থেকে যে অস্ত্র লক্ষ্যে শুলের সমান [পীড়াকারক শত্রুর সম্মুখে] ধাবিত হয় ইহা ভূমির মধ্যে পড়ে না থাকে ঘাসআদির মধ্যে না থাকে। আমাদের সম্পদকে ইচ্ছাকারী গুণবান দের জন্য অর্পনকৃত হোক।
. তাহলে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে যজ্ঞে পশু বধ নিষিদ্ধ। যে বেদ পশু পালনের সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়। সে বেদ পশু হত্যার বিধান কি করে দিতে পারে?
The rigbed and vedic religion নামক পুস্তকের লেখক ক্লেটন ((Clayton) পশু যজ্ঞ ( Animal sacrifice) শীর্ষক নাম দিয়ে উক্ত পুস্তকে লিখেছেন -
At one sacrifice, probably a very unusual sacrifice, performed once in five years called the pancha sharadhya sava, seventeen young cow were offered bullocks, buffaloes and deer were also sacrificed,some time in large numbers, The White Yajurveda men-tions 327 domestic animals including, oxen,cow, milch cows that are to be offered along with the great horse sacrifice,
-The Rigveda and Vedic Religion by Clayton,
অর্থাৎ সম্ভবত একটি বৃহৎ য্জ্ঞে সতেরটি যুবতি গাভি বলি দেওয়া হতো। বৃষ, মহিষ ও হরিণদের বলিও কয়েকবার অত্যন্ত বহুল পরিমাণে সংঘটিত হতো।শুক্ল যজুর্বেদ তিনশত সাতাইশটি গৃহপালিত পশুর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার মধ্যে বৃষ,গাভি,দুগ্ধবতী গাভীর বলি অস্বমেধ যজ্ঞে অশ্বরের সহিত সম্পন্ন করা হতো। ক্লেটন এই ভুল তথ্যটি সংগ্রহ করেছেন ড.রাজেন্দ্র লাল মিত্র লিখিত Indo Aryan নামক পুস্তক থেকে যার মধ্যে আর্যকে গোমাংস ভক্ষক ও মদ্যপায়ী প্রতিপন্ন করার চেষ্ঠা করা হয়েছে। বৈদিক এজ্ বইটির লেখকও অনেকাংশে পশ্চাত্য ব্যক্তিদের দ্বা প্রভাবিত যদিও তিনি এই বিষয়ে কয়েকটি পরস্পর বিরুদ্ধ মতের উল্লেখ করে একটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। আমরা সেই গুলি প্রথমে উপস্হিত করে তারপর আমরা তার সপ্রমাণ মীমাংসা করবো।
সূয়বসাদ্ ভগবতীহিভূয়া অথো বয়ং ভগবন্তঃ স্যামন। অদ্ধি তৃনমঘ্ন্যে বিশ্বদানীং পিব শুদ্ধমুদ কমাচরন্তী।।
ঋগ্বেদ-১/১৬৪/৪০
এখানে গাভিকে অঘ্ন্যা নামে সম্ভোধন করে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে- তুমি তৃণ ও শুদ্ধ জল সেবন করে সুস্হ থাকো। আমরাও তোমার উত্তম সাত্ত্বিক দুগ্ধ সেবন করে ধর্ম, জ্ঞান ও ঐশ্বরর্যযুক্ত হই।।
হিংকৃন্বতী বসুমতি বসুনাং বৎ সমিচ্ছন্তী মনসাভ্যাগাৎ। দুহামশ্বিভ্যাং পয়ো অঘ্ন্যেয়ং সা বর্ধতাং মহতে সৌভগায়।।
ঋগ্বেদ-১/১৬৪/২৭
এখানেও গাভির জন্য অঘ্ন্যা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।এবং তার আরোগ্যাদি হেতু বলা হয়েছে।
অস্য শ্রেষ্ঠা সুভগস্য সন্দৃগ্ দেবস্য চিত্রগত মর্ত্যেষু। শূচিং ঘৃতং ন তপ্তমঘ্ন্যায়াঃ স্পার্হা দেবস্য মংহনেবধেনোঃ।।
ঋগ্বে-৪/১/৬
এই মন্ত্রে গাভিকে অঘ্ন্যা নামে সম্ভোধন করে পরমেশ্বরের দর্শনের সঙ্গে তার পবিত্র, তপ্ত ঘৃতর উপমা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কাম্য শক্তি ও বুদ্ধিবর্ধক দুদ্ধ ধারার সমান প্রভুদর্শন বলা হয়েছে।
ধুতেন দ্যাবাপৃথিবী ব্যুন্ধি সুপ্রপানং ভবত্বঘ্ন্যায়াঃ।।
ঋগ্বেদ-৫/৮৩/৮
অর্থাৎ সর্বদা অগন্তব্য গাভির জন্য জল সেবনাদির উত্তম ব্যবস্হা হওয়া বাঞ্চনীয় এবং তার শুদ্ধ ঘৃত দ্বারা পৃথিবী ও আকাশ পূর্ণ করে দেওয়া উচিত, গোঘৃত দ্বারা হবন করার ইঙ্গিতও এই মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদের ১০/৮৭/১৬ মন্ত্রটিতে গাভিকে অঘ্ন্যা নামে সম্ভোধন করে তার দুগ্ধের বলবৎ হরণকারী ও তার হত্য্কারীর জন্য কঠোর দন্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে-
য়ঃ পৌরুষেয়েন ক্রবিষা সমঙ্ ক্তে য়ো অশ্ব্যেন পশুনা য়াতুধানঃ। য়ো অঘ্ন্যায়া ভরতি ক্ষীরমগ্নে তেষাং শীর্ষানি হরসাপিবৃশ্চ।।
এই মন্ত্রে অশ্ব ও অন্য পশুর মাংস ভক্ষণকে শুধু পাপ বলা হয়নি বরং এমন যাতুধান -হিংসাকারী পাপীদের জন্য প্রাণদন্ড পর্যন্ত দেওয়ার বিধান আছে অবশ্য থাকে প্রেমপূর্বক বুঝালেও যদি সে তা মানতে রাজী না হয়। মনু মহারাজও লিখেছেন -
য়ক্ষরক্ষঃ পিশাচান্নং মদ্যং মাংসমথাসরম।।
অর্থাৎ মদ্য, মাংস,আসবাদি মাদক দ্রব্যের সেবন যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচাদি করে থাকে, ধার্মিক পুরুষদের এই সব কখনও সেবন করা উচিত নয়।
ঋগ্বেদের মন্ত্রে উদাহরণ হিসেবে এখানে উদ্ধৃত করা হলো যেখানে গাভিকে 'অঘ্ন্যা' নামে সম্ভোধন করে একে অগন্তব্য অর্থাৎ হত্যা করার যোগ্য নয় বলা হয়েছে। এই রকম বহু মন্ত্র বেদে আছে,গোঘাতকদের রাজ্য থেকে বহিস্কৃত করা এবং তাদের সর্বস্ব হরণ করা পর্যন্ত আদেশ অনেক মন্ত্রে পাওয়া যায়, উদাহরণ হিসেবে নিম্ন মন্ত্র দেখেন-
বিষং গাং বা য়াতুধানা ভবন্তামা বৃশ্চন্তামদিতয়ে দুরেবাঃ। পরেনৈনান্ দেবঃ সবিতা দদিতু পরা ভাগমোষ ধীনাং জয়ন্তাম্।।
ঋগ্বেদ-১০/৮৭/১০/অথর্ব-৮/৩/১৬
অর্থাৎ যদি ( য়াতুধানাঃ) প্রজার উপর অত্যাচারকারীরা (গবাম্) গবাদি পশুকে (বিষম্ ভরন্তাম্) বিষ দেয় এবং তাদেরকে হত্যা করে এবং যদি ( দুরেবাঃ) দুষ্ট আচরণকারীরা (অদিতয়ে) গাভিকে (আবৃশ্চন্তাম্) কর্তন করে তবে (সবিতা দেবঃ) সকলের প্রেরণা দাতা রাজা (এনান্) তাদেরকে (পরা দদাৎ) রাজ্য থেকে বহিস্কৃত করুন অধবা তাদের সর্বস্ব হরণ করুন এবং তারা যেনো (ওষধিনাম্) অন্নও ঔষধের অংশ (ন পরাজয়ন্তাম্) প্রাপ্ত না হয়।
'অঘ্ন্যা' শব্দের প্রয়োগ ছাড়া ঋগ্বেদের-৮/১০১/১৫ মন্ত্রে গাভি হত্যার নিষেধ পরিস্কার ভাবে বিদ্যমান -
মাতা রুদ্রানাং দুহিতা বসুনাং স্বসাদিত্যানাম মৃতস্য নাভিঃ। প্র নূ বোচ চিকিতুষে জনায় মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।
অর্থাৎ রুদ্র ব্রহ্মচারিদের মাতা,বসু ব্রহ্মচানিদের দুহিতা, আদিদ্য বোহ্মচারিদের স্নেহশীলা, দুদ্ধমৃতের কেন্দ্ররূপী ভগিনী, (অনাগম্) নির্দোষ (অদিতম্) অখণ্ডনীয়া (গাম্) গাভিকে (মা বদিষ্ট)কখনও বধ করিবে না, আমি (চিকিতুষে জনায়) প্রত্যেক বিচারশীল মানুষের জন্য (প্রনুবোচম্) উপদেশ করছি।
যজুর্বেদে গোবধনিষেধমূলক স্পষ্ট উপদেশ।
ঋগ্বেদের মতো যজুর্বেদেও গাভির গুরুত্ব নির্দেশকারী এবং তার প্রতি হিংসা নিষেধ ও গোহত্যাকারীকে প্রাণদন্ড দেওয়ার অনেক মন্ত্র আছে:যথা -
ইমং সাহস্রং শতধারমুৎসং ব্যচ্যমানং সরিরস্য মধ্যে। ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।।
যজু-১৩/৩৯
অর্থাৎ হে (অগ্নে) দয়ালু, পরোপকারী রাজন,তুমি (জনায়)মনুষ্যাদি প্রাণীদের জন্য (ইমম্)এই (সাহস্রম্) অসংখ্য সুখের সাধন,(শতধারম্)অসংখ্য দুগ্ধ খাবার নিমিত্ত ( ব্যচ্যমানস্) বহুভাবে পালনীয় (উৎ তম্) কুঁয়ার মতো রক্ষাকারী, বীর্যসেবক বৃষের সমান (ঘৃতম্) ঘৃতকে (দুহানাম্) পূর্ণ করে (অদিতিম্) কখনও হত্যা করার যোগ্য নয় গাভিকে (মা হিংসীঃ) হত্যা করবে না।
রাজার জন্য এই আদেশের তাৎপর্য এই যে, তিনি রাজ্যে বিধি বা আইন দ্বারা গোবধ ( গাভি, বৃষ, মহিষ ও বাছুর ইত্যাদি বদ) বন্ধ করে দিন। যদি কেউ এই আদেশ উল্লঙ্ঘন করে তাহলে তার জন্য যজুর্বেদে বিধান দিয়েছে-
অন্তকায় গোঘাতক।।যজু-৩০/১৮
[অথর্ব্বেদে গোবধনিষেধ-মূলক আদেশ]
অন্যান্য বেদের মতো অর্থব্বেদেও গোরক্ষা প্রতিপাদক ও গোহত্যা নিষেধ মূলক মন্ত্র পাওয়া যায়। গাভির জন্য অঘ্ন্যা" শব্দের বহু প্রয়োগ আছে, উদাহরণ হেতু দেখেন- সহৃদয়ং সাংমনস্যম বিদ্বেষং কৃনোমি বঃ।
অন্যো অন্যমভিহর্ষিত বৎ সং জাতমিবাঘ্ন্যা।।।
অথর্ব-৩/৩০/১
এই মন্ত্রের মাধ্যমে ঈশ্বর উপদেশ দিচ্ছেন -'আমি তোমাদের হৃদয় ও মনকে এক করছি ও দ্বেষভাব দূর করছি। তোমাদের পারস্পরিক প্রেম এই রকম হোক এবং তোমরা একে অপরের কামনা এই রকম তরো যেমন গাভি নবজাত বৎসরের সঙ্গে করে থাকে। এখানে গাভির জন্য অঘ্ন্যা শব্দের প্রয়োগ হয়েছে যার অর্থ অহন্তব্যা-কখনও বধ করার যোগ্য নয়।
যজ্ঞে হিংসার নিন্দা এবং অহিংসার প্রশংসা" এই বৃত্তান্ত মহাভারতের শান্তিপর্বের অন্তর্গত ২৭২ অধ্যায়ে এসেছে। এখানে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ যজ্ঞের মধ্যে পশু বধ করে, তবে নিশ্চয় তার সমস্ত তপ নষ্ট হয়ে যাবে। তস্য তেনানুভাবেন মৃগহিংসাত্মনস্তদা। তপো মহৎ সমুচ্ছিন্ন তস্মাদহিংসা ন যজ্ঞিয়া।। অহিংসা সকলো ধর্মাহিংসা ধর্মস্তথাবিধঃ। সত্যংতেহং প্রবক্ষামি, যো ধর্মঃ সত্যবাদিনাম।। এই প্রকরেন মহারাজ যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্ম কে জিজ্ঞেস করছেন যে, ধর্ম তথা সুখের জন্য যজ্ঞ কিভাবে করা উচিত? ইহার উত্তরে পিতামহ এক তপস্বী ব্রাহ্মন ব্রাহ্মণী দম্পতির বৃত্তান্ত দিয়ে বললেন যে, সেই তপস্বী ব্রাহ্মণের মহান তপ যজ্ঞের মধ্যে পশুবলি দেবার জন্য এক বণ্য মৃগ বধ করার ইচ্ছা মাত্র সমস্ত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এইজন্য যজ্ঞের মধ্যে কখনো হিংসা করা উচিৎ নয়। অহিংসা সার্বত্রিক এবং সর্বকালীন নিত্য ধর্ম। এই প্রমাণ দ্বারা জানা যায় যে, মহাভারত কালে পশু হিংসার বিধান ছিলো না। এমনকি এর পূর্বেও পবিত্র বেদে এ প্রকরন এসেছে- রাজসুয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ। অকাশ্বমেধাবৃচ্ছিষ্টে জীব বর্হিমমন্দিতমঃ।। (অথর্ববেদ ১১।৭।৭) রাজসূয়, বাজপেয়,অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ আদি সব যজ্ঞ অধ্বরঃ অর্থাৎ হিংসা রহিত যজ্ঞ। যাহা প্রাণীমাত্রকে বৃদ্ধি এবং সুখ শান্তি দাতা। এই মন্ত্রে রাজসূয় আদি সব যজ্ঞকে অধ্বরঃ বলে গিয়েছেন। যার একমাত্র সর্ব্বসম্মত অর্থ হিংসা রহিত যজ্ঞ। তাহলে ইহা স্পষ্ট যে, বেদের মধ্যে কোন যজ্ঞে পশুবধের আজ্ঞা নেই। তবুও বেদের নাম নিয়ে যজ্ঞে পশু বধ করা মানে নিজেকে ধোকা দেওয়া এবং নিজের অজ্ঞানতাকে প্রকাশ করা। আবার ইহা দেখ যে, পশু বধ করে প্রাণীমাত্রের কিরকম বৃদ্ধি হচ্ছে? এবং মানুষ কি রকম সুখ প্রাপ্ত হচ্ছে? পরন্ত প্রাণীহত্যা করার সময় তার ঘোর যাতনা প্রাপ্ত হয় এবং তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ইতিহাসও পশুবলির সমর্থন করে নি। এমন কি বেদও। কিন্তু কিছু মূর্খ যাজ্ঞিক( পৌরাণিক) লোক " বৈদিকী হিংসা হিংসা ন ভবতি" এর ঢোল পিটিয়ে যজ্ঞে পশুবধ কে অহিংসার সঙ্গা দিয়ে স্বর্গের মার্গ কে প্রশস্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। এদের বিচার দেখে মনে যে,নিশ্চয় এরা তাদের বুদ্ধি ঘাসক্ষেতে রেখে এসেছিলেন। নতুবা এরকম অর্থ তারা করতো না। " বৈদিকী হিংসা হিংসা ন ভবতি" এর অর্থে মনু মহারাজ কি বলেছেন দেখুন- যা বেদবিহিতা হিংসা নিয়তাস্মিংশ্চরাচরে। অহিংসামেব তাং বিদ্যাদ্বেদাদ ধর্মো হি নির্ব্বভৌ।। যো হিংসকানি ভুতানি হিনস্ত্যান্তসুখেচ্ছয়া। স জীবংশ্চ মৃতশ্চৈব, নকশ্চিক সুখমেধতে।। (মনুস্মৃতি ৫।৪৪- ৪৫) অর্থাৎ বেদে বিশ্ব সংসার মধ্যে দুষ্ট আততায়ী, ক্রুর পাপীকে দন্ড দান রূপ হিংসা বিহিত আছে তাহা অহিংসাই জানবে। কারন বেদ দ্বারাই যথার্থ ধর্মের প্রকাশ হয়। কিন্তু ইহার বিপরীতে যে নিরপরাধ,অহিংস প্রাণীকে নিজ সুখ প্রাপ্তির জন্য হত্যা করে সে জীবিত অথবা মৃত এই দুই অবস্থায় কখনোই সুখ পায় না। দুষ্টকে দন্ড প্রদান করা হিংসা নয় পরন্ত অহিংসারূপ পূণ্য তাহা মনুস্মৃতি ৮।৩৫১ এ স্পষ্ট আছে- " নাততায়িবধে দোষো হন্তুর্ভবতি কশ্চন" অর্থাৎ আততায়ি ( যে ব্যক্তি বধ উদ্যত) তাহাকে বধ করিলে কোন দোষ নেই।

যজ্ঞ অর্থাৎ হিংসারহিত কর্ম্ম, অশ্বমেধ যজ্ঞে যদি অশ্ব অগ্নিতে অর্পন বা অশ্ব হত্যা করার কতা লেখা থাকে তবে পিতৃযোজ্ঞে কি পিতার আহুতি দেওয়া হবে ?
পিতৃযোজ্ঞ- অর্থাৎ যাহাতে দেব অর্থাৎ বিদ্বান, ঋষি অর্থাৎ যঁহারা অধ্যয়ন অধ্যাপনা করেন এবং পিতর অর্থাৎ মাতা, পিতা,বৃদ্ধ,জ্ঞানী এবং পরম যোগী-ইহাদের সেবা করা।
পিতৃযোজ্ঞ দ্বিবিধ- প্রথম শ্রাদ্ধ দ্বিতীয় তর্পণ। শ্রাদ্ধ অর্থাৎ "শ্রৎ সত্যের নাম, "শ্রীৎ সত্যং দধাতি যয়া ক্রিয়য়া সা শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধয়া যৎ ক্রিয়তে তচ্ছ্রাদ্ধম্"।।-যে ক্রিয়া দ্বারা সত্য গ্রহণ করা যায় তাহাকে শ্রদ্ধা বলে
এবং শ্রদ্ধা পূর্ব্বক যে কর্ম্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহার নাম শ্রাদ্ধ। আর "তৃপ্যন্তি তর্পয়ন্তি যেন পিতৃন্ তত্তর্পণম্"-যে যে সকল কর্ম্মের দ্বারা বিদ্যমান মাতা পিতা প্রভৃতি পিতৃগণ তৃপ্ত অর্থাৎ প্রসন্ন হন, এবং যে সকল ক্রিয়ার দ্বারা তঁহাদিগকে প্রসন্ন করা যায় তাহার নাম তর্পণ। কিন্তু তাহা জীবিতদিগের জন্যই, মৃতদিগের জন্য নহে।

পুরাণ ও বেদের রূঢ় অর্থকার মহীধর ভাষ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞঃ হিংসা আর অশ্লীলতার তাণ্ডব নৃত্য

 নীম্নে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলঃ

ধর্মের ধান্দাবাজেরা ভোলাভালা মানুষদের পকেট সাফ করার জন্য, নেতাগিরি কে চমকানোর জন্য আবারো যজ্ঞকে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। যজ্ঞের ‘এই’ অথবা ‘ওই’ নাম রেখে ধর্মভীরু মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য বড় বড় আড়ম্বর করা হচ্ছে। এইজন্যই তো এই দেশের প্রাচীন বুদ্ধিবাদীরা এ বিষয়ে আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেছিলেনঃ বৃক্ষান্ ছিত্বা পশুন্ হত্বা কৃত্বা রুধিরকর্দমম্ , যদ্যেবং গম্যতে স্বর্গো নরকঃ কেন গম্যতে। ( পদ্মপুরাণ হতে উদ্ধৃত) অর্থাৎ যদি গাছ কেটে, পশুকে হত্যা করে স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, তবে নরকের প্রাপ্তি কিভাবে হয়? তারপরও বিশ্বশান্তির জন্য ‘অশ্বমেধ’ করা হল। বামন শিবরাম আপ্তে তার ‘দা প্র্যাকটিকাল সংস্কৃত ডিকশনারি’তে অশ্বমেধের অর্থ লিখেছেনঃ অশ্বঃ প্রধানতয়া মেধ্যতে হিংস্যতে অত্র। অর্থাৎ, যেই যজ্ঞে প্রধানত ঘোড়াকে হত্যা করা হয়, তাই অশ্বমেধ। সংস্কৃতের বৃহৎ শব্দকোষ ‘শব্দকল্পদ্রুম’ এ অশ্বমেধের অর্থ করা হয়েছেঃ যত্র লক্ষণবিশেষাক্রান্তমশ্বং সংপ্রোক্ষ্য কপালে জয়পত্রং বদ্ধ্বা ত্যজেন্। তদ্রক্ষার্থ পুরুষবিশেষং নিয়োজয়েত্ সংবৎসারান্তে অশ্বে আগতে সতি। অথবা কেনাপি সংবদ্ধে যুদ্ধং কৃত্বা তমানীয় যথাবিধি বধং কৃত্বা তদ্ বপয়া হোমঃ কর্তব্যঃ কামনানুসারেণ তৎফলম্ , মোক্ষঃ, ব্রহ্মহত্যাপাপক্ষয়ঃ, স্বর্গশ্চ। অর্থাৎ এই যজ্ঞে বিশেষ লক্ষণ যুক্ত ঘোড়ার উপর পবিত্রকারী জল মন্ত্রোচ্চারণ করে ছিটিয়ে , তার কপালে জয়পত্র বেঁধে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার রক্ষার জন্য বিশেষ পুরুষকে নিযুক্ত করা হয়। এক বছর পর ঘোড়া ফিরে এলে অথবা সেই ঘোড়াকে কেউ যদি বেঁধে রেখে থাকে তবে তাকে যুদ্ধে হারিয়ে ঘোড়াকে ফিরিয়া আনার পর তাকে শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে হত্যা করে তার চর্বি দিয়ে হোম করা হয়। কামনা অনুসারে ফলপ্রাপ্তি হয়ে থাকে- মোক্ষ, ব্রহ্মহত্যাপাপ নাশ করে স্বর্গের প্রাপ্তি ।
আশ্বালায়ন শ্রৌতসূত্র pdf


কিন্তু শতপথ ব্রাহ্মণগ্রন্থে দেখি রাষ্ট্রং বা অশ্বমেধঃ।'বীয়ং বা অশ্ব (শতপথ০১৩.১.৬১)।।

অর্থাৎ অশ্ব শব্দবীর্যবাচক ও বটে অতএব, দেশবাসীর শাের্য-বীর্য বৃদ্ধি করা এবং রাষ্ট্রকে সম্যক্ পরিচালনা করা ‘অশ্বমেধ’ শব্দের অভিপ্রায়।

নিম্ন মন্ত্রগুলিও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য কেননা এগুলিতে যজ্ঞে পশুবলির স্পষ্ট নিষেধ পাওয়া যায়-

নকিদেবাইনীমসিনক্যায়ােপয়ামসি,মন্ত্ৰত্যং চরামসি।। সামপূর্ব ২.৪.২। | এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার সায়ণাচার্য লিখছেন – হে দেবাঃ! য়ুষ্ম বিষয়ে কিমপিন হিংস্ম শ্রুতৌবিধিবাক্য প্রতিপদ্যং য়দ য়ুষ্ম বিষযে কর্ম তৎ আচরামঃ।' (সামসংহিতা ভাষ্যম কলিকাতা সং পৃ০ ৯৫), সুপ্রসিদ্ধ বিদ্বান্ সত্যব্রত সামশ্রয়ী তাঁর ব্যাখ্যায় লিখেছেন - ‘প্রাণিবধং কর্ম পশ্বাদিয়াগং ন কুর্মঃ।'

অর্থাৎ আমরা প্রাণিবধরূপপশ্বাদ্যিগকরিনা। মীঞ হিংসায়াম প্রযুক্ত হয়েছে এতএব অর্থ পরিস্কার যে আমরা হিংসাত্মক কর্ম করি না। লােকদেরকে প্রলােভন দিয়েও মন্দ কর্ম করাই না। আমরা বেদের উপদেশ অনুযায়ী আচরণ করি। “অধ্বর' শব্দের ব্যবহার বহুমন্ত্রে এসেছে যার দ্বারা পশুবলি নিষেধ করা হয়েছে। সন্দেহ নাই।

ক) ভদ্রো নাে অগ্নিবাহুতাে ভদ্রা রাতিঃ সুভগ ভদ্রো অধ্বরঃ। ভদ্রাউত প্রশস্তায়ঃ।। পূর্ব২.২.৫

খ) ত্বমগ্রে গৃহপতিস্তং হােত নাে অধ্বরে।

 ত্বং পােতা বিশ্ববার প্রচেতায়ক্ষিয়াসিচবায়।। পূর্বা০২.২.৬। |

গ) তং হােতারমধ্বরস্য প্ৰচেতসংবহ্নি দেবা অকৃত।

 দধাতিরং বিধর্তেসুবীয়অগির্জনায় দাশুষে।। উত্তরা০৭.৩.২. |

ঘ) স নােমন্দ্রাভিরধ্বরে জিহ্বাভিয়জামহঃ। আ দেবাক্ষি য়চি ।।। | উত্তরা ৬.৩.৮.২ |

ঙ) বাজী বাজে ধীয়তেধ্বরেষু প্ৰণীয়তে। বিপ্রােয়জ্ঞস্য সাধনঃ।। উত্তরা ৬.৩.৫.২ |

সত্যব্রত সামশ্রমীরমতােমত ব্যক্তকরেছেন ভাষ্যকার নারায়ন পুত্র মাধব। তিনি তাঁরবক্তব্য নিম্নশব্দেব্যক্ত করেছেন | ন কি দেবা ইনীমসি। নেতি প্রতিষেধঃ। ইনীমসি। মিনাতেহিংসার্থকস্য মকারলােপঃ। তেনৈতদুক্তং ভবতি। হে দেবানইনীমসি। প্রাণিবন্ধনকর্ম। পশ্বাদিয়াগং নকর্ম, ইত্যর্থঃ। ন ক্যামিেপয়ামসিয়ােপয়তির্বিমােহনকর্মা। সইহনিখননার্থেদ্রষ্টব্যঃ। মন্ত্র শ্রুত্যং মন্ত্রশ্রবণীয়ং জপাখ্যং চরামসি। জপং কুন্তশ্চরামঃ। প্রাণিবধং ন কুর্মঃ। জপমেব কৃর্মঃ ইত্যর্থঃ (সামবেদ সংহিতা ডঃ কুন্নরাজ সম্পাদিতা মাধব ভরত স্বামিভাষ্য সংহিতা অড়য়ার, মাদ্রাস পৃ০১৩৭.১৩৮)।

পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর ভাষ্যের সঙ্গে এর হুবহু মিল থাকায় পৃথকভাগে শব্দার্থ করার দরকার নেই। এখানেও পশুহিংসাত্মক যজ্ঞের নিষেধ অত্যন্ত স্পষ্ট।


অথর্ববেদে অধ্বর শব্দ অথর্ববেদেও এইরূপ বহুমন্ত্র উপস্থিত করা যেতে পারে যেখানে যজ্ঞের জন্য অধ্বর শব্দের প্রয়ােগ এবং পশুহিংসাত্মক যজ্ঞের নিষেধ করা হয়েছে–

ক) যশ্চৰ্ষণিভােবৃষভঃ স্বর্বিদয়স্মৈ গ্ৰাবাণঃ প্ৰবদন্তিনৃণা। স্যারঃ সপ্তহােতা মদিষ্ঠঃ স নাে মুঞ্চত্বংহসঃ।। অ থ ব ০ ৪.২৪.৩

খ) য়মঃ পরােবরােবিবস্বাতন্তুঃ পরংনাতিপশ্যামিকিঞ্চন। য়মে ধ্বরাে অধিমেনির্বিক্টোভুববাবিবস্বানন্বততান।।

অথর্বঃ ১৮.২.৩২

গ) অমূয়া উপসূর্যে আভির্বা সূর্যঃ সহ। তা নাে হিন্বধ্বর।। অথর্বঃ১.৪.২ |

ঘ) তন্নপাৎ পথঋতস্য য়ানামব্বাসমং জনস্বদয়াসুজি। মন্মানি ধীভিরুত যজ্ঞমৃন্ধন দেবত্ৰা চকুনুহ্যধ্বরং নঃ।। অথর্ব৫ে .১২.২ |

तनू॑नपात्प॒थ ऋ॒तस्य॒ याना॒न्मध्वा॑ सम॒ञ्जन्त्स्व॑दया सुजिह्व। मन्मा॑नि धी॒भिरु॒त य॒ज्ञमृ॒न्धन्दे॑व॒त्रा च॑ कृणुह्यध्व॒रं नः॑ ॥

पदार्थान्वयभाषाः -(तनूनपात्) हे विस्तृत पदार्थों के न गिरानेवाले, (सुजिह्व) हे बड़े जयशील वा मधुरभाषी विद्वान् ! (ऋतस्य) सत्य के (यानान्) चलने योग्य (पथः) मार्गों को (मध्वा) ज्ञान से (समञ्जन्) प्रकट करता हुआ (स्वादय) स्वाद ले (धीभिः) कर्मों के साथ (मन्मानि) ज्ञानों (उत) और (यज्ञम्) पूजनीय व्यवहार को (ऋन्धन्) सिद्ध करता हुआ तू (देवत्रा) विद्वानों के बीच (नः) हमारे लिये (अध्वरम्) सन्मार्ग देनेवाला वा हिंसारहित व्यवहार को (च) अवश्य (कृणुहि) कर ॥5-12-2

भावार्थभाषाः -आप्त विद्वान् पुरुष ज्ञानकाण्ड और कर्मकाण्ड में निपुण होकर संसार का उपकार करते हैं ॥२॥

टिप्पणी:२−(तनूनपात्) नभ्राण्नपान्नवेदा०। प० ६।३।७५। इति न+पत्लृ अधःपतने, णिच्−क्विप्। नञः प्रकृतिभावश्च। हे तनूनां विस्तृतानां पदार्थानां न पातयितः। तनूनपात् पदनाम−निघ० ५।२। इदं पदं बहुधा व्याख्यातम्−निरु० ८।५। (पथः) मार्गान् (ऋतस्य) सत्यस्य (यानान्) करणाधिकरणयोश्च। पा० ३।३।११७। इति या प्रापणे−ल्यु। यातव्यान् (मध्वा) मन ज्ञाने−उ नस्य धः। ज्ञानेन (समञ्जन्) सम्यक् प्रकटीकुर्वन् (स्वदय) आस्वादय (सुजिह्व) शेवायह्वजिह्वा०। उ० १।१५४। इति जि जये−वन् हुक् च। हे अतिशयेन जयशील मधुरभाषिन् वा (मन्मानि) सर्वधातुभ्यो मनिन्। उ० ४।१४५। मन ज्ञाने−मनिन्। ज्ञानानि (धीभिः) कर्मभिः−निघ० २।१। (उत) अपि च (यज्ञम्) पूजनीयं व्यवहारम् (ऋन्धन्) संसाधयन् (देवत्रा) विद्वत्सु (च) अवश्यम् (कृणुहि) कुरु (अध्वरम्) अ० १।४।१। सन्मार्गदातारं हिंसारहितं वा व्यवहारम् (नः) अस्मभ्यम् ॥-पण्डित क्षेमकरणदास त्रिवेदी

ঙ) অংহােমুচং বৃষভং যজ্ঞিয়ানাং বিরাজং প্রথমমধ্বরানা। অপাং নপাতমশ্বিনা হুবে ধিয় ইন্দ্রিয়েন ত ইন্দ্রিয়ং দত্তমােজঃ।। | অথর্বঃ১৯.৪২.৪

চ) সমধ্বরায়ােষসােনমন্ত দধিক্রাবেব শুয়ে পদায়।।।

অথর্ব ৩.১৬.৬ |

মূখ্যতঃ যজ্ঞের সমানাের্থক শব্দ ‘মেধ’ কে অজমেধ, গােমেধ, পুরুষমেধ, অশ্বমেধ ইত্যাদি শব্দ কে বোঝানো হয়েছে (যদিও বেদে অশ্বমেধ শব্দ ছাড়া অন্য শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় না) বৈদিক যজ্ঞে পশুবলি দেওয়ার বিধান সম্বন্ধে ভ্রান্তি জন্মে। মেধূ ধাতুর ‘মেধা সংগমন য়ােহিংসায়াং চ' এই ধাতু পাঠ অনুযায়ী মেধার তিনটি অর্থ হয় – শুদ্ধবুদ্ধি বৃদ্ধি করা, লোেকদের মধ্যে একতাও প্রেমবৃদ্ধি করা ও হিংসা। হিংসাই এই শব্দের একমাত্র অর্থ নয় যদিও প্রায়ই লােকেরা ভ্রান্তিবশত সেইরূপ অর্থ গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং অকারণে হিংসা শব্দের উপর জোর দেওয়ার কোন অর্থ হয়না। নিম্নলিখিত প্রমাণ দ্বারা এবং সাধারণ বুদ্ধিপ্রয়ােগে হিংসা অর্থ গ্রহণ করা নিত্যন্ত অসঙ্গত মনে হয়।

পুরুষমেধ, পুরুষযজ্ঞ ও নৃযজ্ঞ এই তিনটি শব্দ সমান অর্থ বহন করে। মনুস্মৃতিতে নৃযজ্ঞের ব্যাখ্যা তিথিপূজন’ (মনু০৩.৭০) এইরূপ করা হয়েছে। এর অর্থমনুষ্যকে যজ্ঞে বলি দেওয়ানয়বরং উত্তমবিদ্বানদেরবিশেষত অতিথিদেরপূজাঅর্থাৎ সেবা-যত্ন করা। মেধৃ ধাতুর সংগমনার্থগ্রহণ করলে এর তাৎপর্য দাঁড়ায় – মনুষ্যদেরকে উত্তম কার্যের জন্য সংগঠিত করা, তাদের মধ্যে ঐক্য ও প্রেম বৃদ্ধি করা। সামবেদ উত্তরাচিক অধ্যায় ১৪২ - ‘আহরয়ঃসসৃজিরেরুষীরধিবহিষি। য়ত্রাভিসংনবামহে।।' এই মন্ত্রের ঋষি মেধ পুরুমেধ অষ্টম প্রপাঠকের ‘পর্ষি তােকং তনয়’ – এই মন্ত্রের ঋষি মেধ। এইগুলির

এছাড়াও অজস্রমন্ত্র পাওয়া যায় যেখানেগাভী, অশ্ব, মেষাদি পশুদের প্রতিহিংসাকরানিষেধকরাহয়েছে। অধ্বরশব্দযজ্ঞের সমার্থক ও বিশেষণরূপেব্যবহৃত হয়েছে, এইরকমমন্ত্রেরসংখ্যা কমপক্ষে ৪৩।

যেকোনো ব্যক্তি অশ্বমেধ করতে পারে না। কেবল রাজাই তা করতে পারে এবং সে রাজাকে ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ হতে হয়। অন্য বর্ণের কেউ এই যজ্ঞ করতে পারে না। প্রায়শ্চিত্তবিবেক (১৪-১৫ শতাব্দী) বলছেঃ অশ্বমেধপ্রায়শ্চিত্তং তু রাজ্ঞ এব তত্র তস্যৈবাধিকারাত্। অর্থাৎ, পাপনাশের জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ কেবল রাজাই করতে পারে, কেননা তারই এর অধিকার রয়েছে। ভবিষ্য পুরাণের মত হল যদি ব্রাহ্মণ অজ্ঞানতাবশত ব্রহ্মহত্যার পাপ করে তবে তার অশ্বমেধ যজ্ঞ করার অধিকার রয়েছেঃ যদা তু গুণবান্ বিপ্রা হন্যাদ্ বিপ্রং তু নির্গুণম্। অকামতস্তদা গচ্ছেত্ স্নানং চৈবাশ্বমেধিকম্।। অর্থাৎ, যদি না চেয়েও কোনো গুণবান ব্রাহ্মণ কোনো নির্গুণ ব্রাহ্মণোকে হত্যা করে তবে সে অশ্বমেধ যজ্ঞে স্নান করবে অর্থাৎ অশ্বমেধ করবে। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনেকরমের ফল বলা হয়েছে। যেমনঃ সর্বান্ কামানাপ্স্যন্ সর্বা বিজিতীর্বিজিগীষমাণঃ সর্বা ব্যুষ্টীর্ব্যশিষ্যন্নশ্বমেধেন যজেত। ( আশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্র ১০/৬/১) অর্থাৎ, সর্ব পদার্থের ইচ্ছুক, সব জয় করতে অভিলাষী এবং অতুল সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষাকারীদের অশ্বমেধ যজ্ঞ করা উচিত। অনুপাতকিনস্ত্বেতে মহাপাতকিনো যথা, অশ্বমেধেন শুধ্যন্তি। – বিষ্ণুস্মৃতি ৩৬/৮ অর্থাৎ, ছোটো এবং বড় সব রকমের পাপী অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা শুদ্ধ হয়ে যায়। তরতি ব্রহ্মহত্যাং যোহশ্বমেধেন যজতে। -তৈত্তিরীয় সংহিতা ৫/৩/১২/২ অর্থাৎ ব্রাহ্মণের হত্যার পাপ অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা দূর হয়ে যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ (১৩/১/৯/৯) বলে অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা বীর পুত্রের জন্ম হয়। এখানে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো চিহ্নই তো পাওয়া যাচ্ছে না। জানা নেই হায়দ্রাবাদে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ‘নরকে নিয়ে যাওয়া শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচরণ’ কেন করা হল? যজ্ঞ বিধির রূপরেখা প্রাচীন গ্রন্থে অশ্বমেধের যে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, তা সংক্ষেপে এইরকমঃ হোতা, অধ্বর্যু, ব্রহ্মা এবং উদগাতা নামক চার পুরোহিতের মধ্যে প্রত্যেককে এক এক হাজার করে গরু দান করা হয় এবং তার সাথে একশো বস্তা ভরে স্বর্ণখণ্ড দেওয়া হয়। ( কাত্যায়ণ গৃহ্য সূত্র ২০/১/৪-৬) তারপর চারজন পুরোহিত অশ্বের গায়ে ছল ছিটিয়ে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।তার সাথে একশ রাজকুমার, একশ উগ্র (যারা রাজা হয় না), সূত (সারথীর কাজ করা এক বর্ণসঙ্কর জাতি) , গ্রামের প্রধান, ক্ষত্র (এক বর্ণসঙ্কর জাতি) এবং সংগ্রহীতা থাকে। চার চোখ ওয়ালা এক কুকুরকে ( দুটি চোখ প্রাকৃতিক এবং বাকি দুটি চোখের কাছে বানানো গর্ত) আয়োগব নামক বর্ণসঙ্কর জাতির কোনো বিষয়াসক্ত ব্যক্তি দ্বারা সিধক কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে হত্যা করানো হত। তারপর ঘোড়াকে জলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার পেটের নীচে কুকুরের মৃতদেহকে রশি দিয়ে বেঁধে তাকে প্রস্তুত করা হয়। (আপস্তম্ভ গৃহ্য সূত্র ২০/৩/৬-১৩ , কাত্যায়ন গৃহ্য সূত্র ২২/১/৩৮ , সত্যাষাঢ শ্রৌতসূত্র ১৪/১/৩০-৩৪) ঘোড়ার আগে আগে একটি ছাগলকে নিয়ে যাওয়া হয়। অগ্নিতে আহুতি দিয়ে ঘোড়াকে স্বাধীনভাবে ঘুরেবেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। তার সাথে চারশ রক্ষক থাকে (যজুর্বেদ ২২/১৯)। এক বছর অবধি ঘোড়া এভাবে ঘুরতে থাকে। যে রাজার রাজ্যে সেই ঘোড়া প্রবেশ করতো সেই রাজ্য যে রাজা ঘোড়া ছেড়েছে সেই রাজার হয়ে যেত, যদি সেই রাজ্যের রাজা তার বিরোধিতা না করতো। বিরোধিতা করলে যুদ্ধ হত। যে রাজা ঘোড়া ছেড়েছে সে যদি রাজা যুদ্ধে হেরে যেত, তবে যজ্ঞ নষ্ট হয়ে যেত। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ (৩/৮/৯) বলছেঃ পরা বা এষ সিচ্যতে যোহবলোহশ্বমেধেন যজতে, যদমিত্রা অশ্বং বিন্দেরন্ হন্যেতাস্য যজ্ঞঃ । অর্থাৎ, যখন অবল ব্যক্তি অশ্বমেধ যজ্ঞ করে তখন তাকে ফেলে দেওয়া হয় অর্থাৎ তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়। যদি শত্রু অশ্বকে ধরে ফেলে তবে অশ্বমেধ যজ্ঞ নষ্ট হয়ে যায়। বছরের শেষে ঘোড়া আবারো অশ্বশালায় নিয়ে আসা হয় এবং একুশটি স্তম্ভ (যূপ) দাঁড় করানো হয়, যেখানে অনেক বলির পশুকে বাঁধা হয়। শূকরের মত বন্য পশু এবং পাখিকেও হত্যা করা হয়। (আপস্তম্ভ গৃহ্য সূত্র ২০/১৪/২) কিছু পাখিকে অগ্নি প্রদক্ষিণ করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর অনেক কর্মকাণ্ডের পর ঘোড়াকে মারা হয়। পটরানী মৃত অশ্বের সাথে সম্ভোগ করে। এই অপ্রাকৃতিক মৈথুনের বিস্তৃত বিবরণ যজুর্বেদের ২৩ অধ্যায়ের উবট এবং মহীধরের ভাষ্যে পাওয়া যায়। এই সম্ভোগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিতৃষ্ণার জন্ম দেয় এবং এর বিবরণ দেওয়াও সম্ভব নয়। হায়দ্রাবাদে হওয়া যজ্ঞে না জানি কার স্ত্রী এই ভূমিকা পালন করেছিল! তারপর পুরোহিত কুমারীদের সাথে এতটা ঘৃণ্য,অশ্লীল কথাবার্তা বলে যে, কোনো সভ্য ব্যক্তি তা পড়তে পারে না। যজুর্বেদ (উবট এবং মহীধর ভাষ্য) এর ২৩ অধ্যায়ে ১০ টি পদ্যে এই বার্তালাপের বর্ণনা আছে। আমি এখানে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পুস্তক ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা থেকে কিছু মন্ত্রের মহীধরোক্ত অর্থ অনুবাদের সাথে অবিকল উদ্ধৃত করতে চাইবো। ১. গণনাং ত্বা গণপতিং হবামহে প্রিয়াণাং ত্বা প্রিয়পতিং হবামহে নিধীনাং ত্বা নিধিপতিং হবামহে বসো মম। আহমজানি গর্ভধমা ত্বমজাসি গর্ভধম্। (যজুর্বেদ ২৩/১৯) ভাষ্যম্ – অস্য মন্ত্রস্য ব্যাখ্যানে তেনাক্তম্- অস্মিন্মন্ত্রে গণপতিশব্দাদশ্বো বাজী গ্রহীতব্য ইতি। তদ্যথা মহিষী যজমানস্য পত্নী যজ্ঞশালায়াং পশ্যতাং সর্বেষামৃত্বিজামশ্বসমীপে শোতে। শায়না সত্যাহ- হে অশ্ব! গর্ভধং গর্ভং দধাতি গর্ভধং গর্ভধারকং রেতঃ, অহম্ আ অজানি আকৃষ্য ক্ষিপামি। ত্বং চ গর্ভধং রেতঃ আ অজাসি আকৃষ্য ক্ষিপসি। ভাষার্থঃ (গণানাং ত্বা) এই মন্ত্রে মহীধর বলেছেন যে গণপতি শব্দে ঘোড়াকে বোঝানো হয়েছে। তাই দেখো মহীধরের অর্থ ‘সব ঋত্বিকের সামনে যজমানের স্ত্রী ঘোড়ার সাথে শোয় এবং শুয়ে ঘোড়াকে বলে, হে অশ্ব! গর্ভধারণ হয় এমন তোর বীর্য টেনে আমি আমার যোনিতে আনি এবং তুই সেই বীর্যকে আমাতে স্থাপন করিস।‘ (স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ঋগ্বেদাদিভাষ্যম, সং যুধিষ্ঠির মীমাংসক, ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা , পৃষ্ঠা ৩৭৪) ২. তাহউভৌ চতুরঃ পদঃ সম্প্রসারয়াব স্বর্গে লোকে প্রোর্ণুবাথাং বৃষা বাজী রেতোধা রেতো দধাতু। -যজুর্বেদ ২৩/২০ মহীধরস্যার্থঃ- ‘অশ্বশিশ্নমুপস্থে কুরুতে বৃষা বাজীতি । মহিষী স্বয়মেবাশ্বশিশ্নমাকৃষ্য স্বযোনৌ স্থাপয়তি’… ভাষার্থঃ মহিধরের অর্থ- ‘যজমানের স্ত্রী ঘোড়ার লিঙ্গ ধরে নিজেই তার যোনিতে প্রবেশ করায়। (ঐ পৃষ্ঠা ৩৭৮) ৩. যকাসকৌ শকুন্তিকাহলগিনি বঞ্চতি, আহুন্তি গর্ভে পসো নিগল্গলীতি ধারকা। -যজুর্বেদ ২৩/২২ মহীধরো বদতি- ‘ অধ্বর্য্বাদয়ঃ কুমারীপত্নীভিঃ সহ সোপহাসং সবদন্তে অঙ্গুল্যা যোনিং প্রদেশয়ন্নাহ- স্ত্রীণাং শীঘ্রগমনে যোনৌ হলহলাশব্দো ভবতীত্যর্থঃ (গর্ভে) ভগে যোনৌ শকুনিসদৃশ্যাং যদা পসৌ লিঙ্গমাহন্তি আগচ্ছতি, (পসঃ) পুংস্প্রজননস্য নাম, হন্তির্গত্যর্থঃ যদা ভগে শিশ্নমাগচ্ছতি, তদা (ধারকা) ধরতি লিঙ্গমিতি ধারকা যৌনিঃ ( নিগল্গালীতি) নিতরাং গলতি বীর্যং ক্ষরতি, যদ্বা শব্দানুকরণং গগ্গলেতি শব্দং করোতি।‘ ৪. যকোহসকৌ – যজুর্বেদ ২৩/২৩ ‘কুমারী অধ্বর্য্যু প্রত্যাহ। অঙ্গুলা লিঙ্গ প্রদেশন্ত্যাহ- অগ্রভাগে সচ্ছিদ্রং লিঙ্গং তব মুখমিব ভাসতে।‘ ভাষার্থ- মহীধরের অর্থ- ‘যজ্ঞশালায় অধ্বর্যু প্রভৃতি ঋত্বিকেরা কুমারী এবং স্ত্রীদের সাথে উপহাসপূর্বক কথা বলে। এভাবে আঙ্গুল দিয়ে যোনিকে দেখিয়ে হাসে। ( আহুলগিতি)। যখন স্ত্রীরা তাড়াতাড়ি চলে, তখন তাদের যোনিতে হলহলা শব্দ হয় এবং যখন যোনিতে লিঙ্গ যুক্ত হয় তখনও হলহলা শব্দ হয় এবং যোনি এবং লিঙ্গ হতে বীর্য পতিত হয়। ‘ (যকোহসকৌ) ‘কুমারী অধ্বর্যুকে উপহাস করে বলে, তোর ছিদ্রযুক্ত লিঙ্গের অগ্রভাগ , তা তোর মুখের মত দেখায়।‘ (ঐ পৃষ্ঠা ৩৭৯) ৫. মাতা চ তে পিতা চ তেগ্রং বৃক্ষস্য রোহতঃ। প্রতিলামীতি তে পিতা গর্ভে মুষ্টিমতং সয়ত্।। -যজুর্বেদ ২৩/২৪ মহীধরস্যার্থ- ‘ব্রহ্মা মহিষীমাহ- মহিষি হয়ে হয়ে মহিষি! তে তব মাতা চ পুনস্তে তব পিতা যদা বৃক্ষস্য বৃক্ষজস্য কাষ্ঠময়স্য মঞ্চকস্যাগ্রমুপরিভাগং রোহনঃ আরোহতঃ, তদা তে পিতা গভে ভগে মুষ্টিং মুষ্টিতুল্যং লিঙ্গমন্তসয়ত্ তং সয়তি প্রক্ষিপতি। এবং তবোত্পত্তিরিত্যশ্লীলম্। লিঙ্গমুত্থানেনালঙ্করোতি, বা তব ভোগেন স্নিহ্যামীতি বদন্নেবং তবোত্পত্তিঃ। ভাষার্থ- মহীধরের অর্থ- ‘এখন ব্রহ্মা হেসে যজমানের স্ত্রীকে বলে – যখন তোর পিতা খাটের উপর উঠে তোর পিতার মুষ্টিতুল্য লিঙ্গ তোর মাতার যোনিতে প্রবেশ করিয়েছিল, তখন তোর জন্ম হয়েছিল। সে ব্রহ্মাকে বলে, তোর জন্মও এভাবেই হয়েছে, দুজনের জন্মই একই ভাবে হয়েছে।‘ (ঐ পৃষ্ঠা ৩৮০) ৬. ঊর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব। অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনন্নিব। – যজুর্বেদ ২৩/২৬ মহীধরভাষ্য- ‘যথা অস্যৈ অস্যা বাবাতায়া মধ্যমেধতাং যোনিপ্রদেশৌ বৃদ্ধিং যাযাত্, যথা যোনির্বিশালা ভবতি, তথা মধ্যে গৃহীত্বোচ্ছ্রাপয়েত্যর্থঃ। দৃষ্টান্তান্তরমাহ- যথা শীতলে বায়ৌ বাতি পুনন্ ধান্যপবনং কুর্বাণঃ কৃষীবলো ধান্যপাত্রং ঊর্ধ্বং করোতি তথেত্যর্থঃ।‘ ৭. যদস্যাহ অংহুমেদ্যাঃ কৃধু স্থূলমুপাতসত্। মুষ্কাবিদস্যাহ এজতো গোশফে শকুলাবিব।। – যজুর্বেদ ২৩/২৮ ‘ যত্ যদা অস্যাঃ পরিবৃক্তায়াঃ কৃধু হ্রস্বং স্থুলং চ শিশ্নমুপাতসত্ উপগচ্ছত্ উপগচ্ছত্ যোনিং প্রতি গচ্ছেত্, তংসং উপক্ষয়ে, তদা মুষ্কৌ বৃষণৌ ইন এব অস্যাঃ যোনেরুপরি এজনঃ কম্পেতে। লিঙ্গস্য স্থূলত্বাদ্ যোনেরল্পত্বাদ্ বৃষণৌ বাহিস্তিষ্ঠত ইত্যর্থঃ। তত্র দৃষ্টান্তঃ – গোশফে জলপূর্ণে গোখুরে শকুলৌ মৎস্যাবিব, যথা উদকপূর্ণ গৌঃ পদে মত্সৌ কম্পেতে।‘ ভাষার্থ- মহীধরের অর্থ- ‘পুরুষেরা স্ত্রীর যোনিকে দুই হাতে টেনে বড় করে নেয়। (যদস্যা অংহু) পরিবৃক্তা অর্থাৎ যে স্ত্রীর বীর্য বের হয়ে যায় , যখন ছোটো এবং বড় লিঙ্গ তার যোনিতে প্রবেশ করানো হয়, তখন যোনির উপর দুই অন্ডকোশ নৃত্য করে , কেননা যোনি ছোটো হয় এবং লিঙ্গ বড়ো। এখানে মহীধর দৃষ্টান্ত দেয় যে- যেমন গরুর খুর দ্বারা গঠিত গর্তে দুই মাছ নাচে এবং যেমন কৃষক ধান এবং তুষকে আলাদা করার জন্য বায়ুপ্রবাহের মধ্যে এক পাত্রে তা ভরে উপরে উঠিয়ে কাপিয়ে থাকে, সেভাবেই যোনির উপর অন্ডকোষ নেচে থাকে। (৬-৭) (ঐ পৃষ্ঠা ৩৮১-৩৮২) ৮. যদ্দেবাসো ললামগুং প্র বিষ্টীমিনয়াবিষুঃ। সক্থ্না দেদিশ্যতে নারী সত্যস্যাক্ষিভুবো যথা। – যজুর্বেদ ২৩/২৯ মহীধরস্যার্থঃ- ‘(যত্) যদা (দেবাসঃ) দেবাঃ দীব্যন্তি কীড়ন্তি দেবাঃ হোত্রাদয়ঃ ঋত্বিজো (ললামগুং) লিঙ্গ (প্র আবিশুঃ) যোনৌ প্রবেশয়ন্তি। ললামেতি সুখনাম, ললামং সুখং গচ্ছতি প্রাপ্নোতি ললামগুঃ শিশ্নঃ, যদ্বা ললামং পুণ্ড্রং গচ্ছতি ললানগুঃ লিঙ্গম্, যোনিং প্রবিশদুত্থিতং পুণ্ড্রকারং ভবতীত্যর্থঃ কীদৃশং ললামগুং ( বিষ্টীমিনং) শিশ্নস্য যোনিপ্রদেশে ক্লেদনং ভবতীত্যর্থঃ। যদা দেবাঃ শিশ্নক্রীড়িনো ভবন্তি, ললামগুং যোনৌ প্রবেশয়ন্তি, তদা (নারী) (সক্থ্না) ঊরুণা ঊরূভ্যাং (দেদিশ্যতে) নির্দিশ্যতে অন্যন্তং লক্ষ্যতে ভোগসময়ে সর্বস্য নার্য্যগস্য নরেণ ব্যাপ্তত্বাদুরুমাত্রং লক্ষ্যতে। ইয়ং নারীতীত্যর্থঃ।‘ ভাষার্থ- মহীধরের অর্থ- ‘ (যদ্দেবাসো) যতক্ষণ পর্যন্ত যজ্ঞশালায় ঋত্বিকেরা হাসাহাসি এবং অন্ডকোষ নাচানোর কাজ করে , ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোড়ার লিঙ্গ মহিষীর যোনিতে কাজ করে। সেই ঋত্বিকদের লিঙ্গও স্ত্রীদের যোনিতে প্রবেশ করে। আর যখন লিঙ্গ দণ্ডায়মান হয়, তখন কমলের সমান হয়ে যায়। যখন স্ত্রী পুরুষের সমাগম হয়, তখন পুরুষ উপরে এবং স্ত্রী নিচে থাকার জন্য ক্লান্ত হয়ে যায়। ৯. যদ্ধরিণো যবমত্তি ন পুষ্টং পশু মন্যতে। শূদ্রা যদর্যজারা ন পোষায় ধনায়তি।। – যজুর্বেদ ২৩/৩০ ১০. যদ্ধরিণো যবমত্তি ন পুষ্টং বহু মন্যতে । শূদ্রো যদর্যায়ৈ জারো ন পোষমনু মন্যতে।। -যজুর্বেদ ২৩/৩১ মহীধরস্যার্থঃ- ‘ ক্ষত্তা পালাগলীমাহ- শূদ্রা শূদ্রজাতিঃ স্ত্রী, যদা অর্যজারা ভবতি, বৈশ্যা যদা শূদ্রাং গচ্ছতি, তদা শূদ্রঃ পোশায় ন ধনায়তে পুষ্টিং চ ইচ্ছতি, মার্যা বৈশ্যেন ভুক্তা সতী পুষ্টা জাতেতি ন মন্যতে, কিন্তু ব্যভিচারিণী জানেতি দুঃখিতো ভবতীত্যর্থঃ। (যদ্ধরিণো) পালাগলী ক্ষত্তারমাহ- যত্ যদা শূদ্র অর্যায়ৈ অর্যায়া বৈশ্যায়া জারো ভবতি, তদা বৈশ্যঃ পোষং পুংষ্টি নানুমন্যতে, মম স্ত্রী পুষ্টা জাতেতি নানুমন্যতে,কিন্তু শূদ্রেণ নীচেন ভুক্তেতি ক্লিশ্যতীত্যর্থঃ। ভাষার্থ- মহীধরের অর্থ- ‘(যদ্ধরিণো) ক্ষত্তা সেবকপুরুষ শূদ্রদাসীকে বলে, যখন শূদ্রের স্ত্রীর সাথে বৈশ্য ব্যভিচার করে, তখন সে তো একথা ভাবে না , আমার স্ত্রী বৈশ্যের সাথে ব্যভিচার করে পুষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু সে একথা ভেবে দুঃখ পায় , আমার স্ত্রী ব্যভিচারিণী হয়েছে। (যদ্ধরিণো) এখন সে দাসী ক্ষতা কে উত্তর দেয়- যখন শূদ্র বৈশ্যের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে তখন বৈশ্যও একথা ভাবেনা , আমার স্ত্রী পুষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু নীচ ব্যক্তি সমাগম করেছে, এই কথা ভেবে দুঃখ পায়। (ঐ , পৃষ্ঠা ৩৮৪) ১১. উৎসক্থ্যাহঅব গুদং ধেহি সমঞ্জিং চারয়া বৃষন্। য স্ত্রীণাং জীবভোজনঃ।। – যজুর্বেদ ২৩/২১ মহীধরস্যার্থঃ যজমানোহশ্বমভিমন্ত্রয়তে। হে বৃষন্! সেক্তঃ অশ্ব! উত্ ঊর্ধ্বে সক্থিনো ঊরু যস্যাস্তস্যা মহিষ্যা গুদমব গুদোপরি রেতো ধেহি বীর্যং ধারয়। কথম্? তদাহ অংঞ্জি লিঙ্গং সঞ্চারয় যোনৌ প্রবেশয়। যোহঞ্জিঃ স্ত্রীণাং জীবভোজনঃ। যস্মিন্ লিঙ্গে যোনৌ প্রবিষ্টে স্ত্রিয়ো জীবন্তি ভোগাংশ্চ লভন্তে তং প্রবেশয়।‘ ভাষার্থ- (উৎসক্থ্যা) এই মন্ত্রের টীকায় মহীধর বলেছেন- ‘ যজমান ঘোড়াকে বলে, হে বীর্য সেচনকারী অশ্ব! তুই আমার স্ত্রীর জঙ্ঘাকে উপড়ে তুলে তার মলদ্বারের উপর বীর্য ঢেলে দে, অর্থাৎ, তার যোনিতে লিঙ্গ চালনা কর। সে লিঙ্গ কোন ধরণের যে, যে সময় যোনিতে প্রবেশ করে, সেই সময় সেই লিঙ্গ স্ত্রীদের জীবন হয়, আর তার দ্বারা তারা ভোগ লাভ করে। এর দ্বারা তুই সেই লিঙ্গকে আমার স্ত্রীর যোনিতে প্রবেশ করিয়ে দে। ‘ (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৮৫) হায়দ্রাবাদে হওয়া অশ্বমেধে কুমারীরা কোথা থেকে এসেছিল বা কোথা থেকে তাদের আনা হয়েছিল, জানা নেই এবং ধর্মের নামে মৌখিক কামতৃপ্তির বাধাহীন উৎসব কোন পুরোহিতেরা করেছিল? তারপর পটরানী অন্যান্য রানীদের সাথে ঘোড়াকে টুকরো করে। ঘোড়াকে কাটার আগে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ এর বিধি অনুসারে তার শরীরে চিহ্ন লাগানো হত যাতে সেই চিহ্ন অনুসারে টুকরো গুলো হয়। তার অধিক বা তার চাইতে আলাদা রকমের টুকরো যাতে না হয়, তার জন্য ছেদককে চারবার সাবধান করা হত, যেভাবে আজকেও যারা মুরগী কাটায়, তারা কসাইকে বলে দেয়। ঘোড়ার অঙ্গ কাটার বিধান ঊষ্মণ্যাপিধানা চরুণামংকাঃ সুনাঃ পরিভূষন্ত্যশ্বম্। ঋগবেদ ১/১৬২/১৩ অর্থাৎ, যে বেতস শাখা দিয়ে অশ্বের অঙ্গকে চিহ্নিত করা হয় আর যে ছুরি দিয়ে চিহ্ন অনুসারে অঙ্গ কাটা হয়, তারা সকলেই অশ্বের মাংসকে প্রস্তুত করে। ঋগবেদের আদি প্রাচীন ব্যাখ্যা গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বিস্তারিত বলা হয়েছে , যজ্ঞে পশুর কোন কোন অঙ্গ কোন কোন ক্রম অনুসারে কাটা উচিত এবং মোট কতগুলি টুকরো করা উচিতঃ উদীচীনাং অস্য পদো নিধত্তাত্সূর্যং চক্ষুর্গময়তাদ্ বাতং প্রাণমন্ববসৃজতাদন্তরিক্ষমসুং দিশঃ শ্রোত্রং পৃথিবীং শরীরমিত্যেষ্বেবৈনং তল্লোকেষ্বাদধাতি ইতি। একধাহস্য ত্বচমাচ্ছ্য়তাত্ পুরা নাভ্যা অপি শসো বপামুত্খিদতাদন্তরেবোষ্মাণং বারয়ধ্বাদিতি পশুষ্বেব তত্ প্রাণান্দধানি ইতি। শ্যেনমস্য বক্ষঃ কৃণুতাত্ প্রশসা বাহু শলা দোষণী কশ্যপেবাংসাহচ্ছিদ্রে শ্রোণী কবষোরু স্রেকপর্ণাহষ্ঠীবন্তা ষড়বিংশতিরস্য বঙ্ক্রয়স্তা অনুষ্ঠ্যোচ্চ্যাবয়তাদ্ গাত্রং গাত্রমস্যানূনং কৃণুতাদ্ ইতি অংগান্যেবাস্য তদ্ গাত্রাণি প্রীণাতি ইতি। ঊবধ্যগোহং পার্থিবং খনতাদিতি… অস্না রক্ষঃ সংসৃজতাদিতি। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬/৬-৭) অর্থাৎ, ইহার পা উত্তরদিক আশ্রয় করুক, চক্ষু সূর্যকে প্রাপ্ত হউক, প্রাণ বায়ুকে, জীবন অন্তরিক্ষকে, শ্রোত্র দিকসমূহকে ও শরীর পৃথিবীকে আশ্রয় করুক- এই বাক্যে ইহাকে ঐ সকল লোকে স্থাপন করা হয়। ইহার ত্বক একভাবে (অবিছিন্নভাবে) ছিন্ন কর। ছেদনের পূর্বে নাভি হইতে বপা (মেদ) পৃথক কর, প্রশ্বাসকে ভিতরেই নিবারণ কর (শ্বাসরোধ করিয়া বধ কর) – এই বাক্যে পশুসমূহেই প্রাণসকলের স্থাপনা হয়। ইহার বক্ষ শ্যেনের (পক্ষীর) আকৃতিযুক্ত কর (সেইরূপে ছিন্ন কর), বাহুদ্বয় উত্তমরূপে ছিন্ন কর, শ্রোণিদ্বয় অচ্ছিদ্র কর, উরুদ্বয় কবষের (ঢালের) মত ও উরুমূল করবীর পাত্রের মত কর; ইহার পার্শ্বাস্থি ছাব্বিশখানি , সেগুলি পরপর পৃথক কর; সমস্ত গাত্র অবিকল (ছিন্ন) কর – এই বাক্যে ইহার সমস্ত অঙ্গ ও গাত্রকে প্রীত করা হয়।ইহার পুরীষ গোপনের জন্য স্থান (গর্ত) পৃথিবীতে (ভূমিতে) খনন কর।… রুধিরের সহিত রাক্ষসগণের যোজনা কর। ( অনুবাদঃ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) মাংসের বিভাগ এরপর সেই ব্রাহ্মণগ্রন্থ বলির পশুর অঙ্গের বিভাগ এর বিধান সম্বন্ধে বলছেঃ অথাতঃ পশোর্বিভক্তিস্তস্য বিভাগং বক্ষ্যাম ইতি। হনু সজিহ্বে প্রস্তোতুঃ শ্যেনং বক্ষ উদ্গাতুঃ কণ্ঠঃ কাকুদ্রঃ প্রতিহর্তুর্দক্ষিণা শ্রোণির্হোতুঃ সব্যা ব্রহ্মণো দক্ষিণং সক্থি মৈত্রাবরুণস্য সব্যং ব্রাহ্মণাচ্ছংসিনো দক্ষিণং পার্শ্বং সাংসমধ্বর‍্যোঃ সব্যমুপগতাতৃণাং সব্যোংহসঃ প্রতিপ্রস্থাতুর্দক্ষিণং দোর্নেষ্টুঃ সব্যং পোতুর্দক্ষিণ ঊরুরচ্ছাবাকস্য সব্য আগ্নীধ্রস্য দক্ষিণো বাহুরাত্রেয়স্য সব্যঃ সদস্যস্য সদং চানুকং চ গৃহপতের্দক্ষিণৌ পাদৌ গৃহপতের্ব্রতপ্রদস্য সব্যো পাদো গৃহপতের্ভার্যায়ৈ ব্রতপ্রদস্যৌষ্ঠ এনয়োঃ সাধারণো ভবতি তং গৃহপতিরেব প্রশিংষ্যাজ্জাঘনীং পত্নীভ্যো হরন্তি তাং ব্রাহ্মণায় দদ্য়ুঃ স্কন্ধ্যাশ্চ মণিকাস্তিস্রশ্চ কীকসা গ্রাবস্তুতস্তিস্রশ্চৈব কীকসা অর্ধং চ বৈকর্তস্যোন্নেতুর্ধং চৈব বৈকর্তস্য ক্লোমা চ শামিতুস্তদ্ব্রাহ্মণায় দদ্যাদ্ যদ্যব্রাহ্মণঃ স্যাচ্ছিরঃ সুব্রহ্মণ্যায়ৈ যঃ শ্বঃসুত্যাং প্রাহ তস্যাজিনমিড়া ( ল্রা) সর্বেষাং হোতুর্বা ইতি। তা বা এতাঃ ষট্ত্রিংশত্মেকপদা যজ্ঞং বহন্তি ষট্ত্রিংশদক্ষরা বৈ বৃহতী। বাহর্তাঃ স্বর্গা লোকাঃ প্রাণাংশ্চৈব তত্স্বর্গাংশ্চ লোকানাপ্নুবন্তি প্রাণেষু চৈব তত্স্বর্গেষু চ লোকেষু প্রতিতিষ্ঠন্তো যন্তি ইতি। স এভ স্বর্গ্যঃ পশুর্ এনমেবং বিভজন্তি ইতি। অথ যেহতোন্যথা তদ্ যথা সে- লগা বা পাপকৃতো বা পশুং বিমথ্নীরংস্তাদৃক্তত্ ইতি। তাং বা এতাং পশোর্বিভক্তিং শ্রৌত ঋষির্দেবভাগো বিদাংচকার তামু হা প্রোচ্যৈবাস্মাল্লোকাদুচ্চক্রামত্ ইতি। তামু হ গিরিজায় বাভ্রব্যায়ামনুষ্যঃ প্রোবাচ ততো হৈনামেতদর্বাঙ্ মনুষ্যা অধীয়তেহধীয়তে ইতি। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ , অধ্যায় ৩১) অর্থাৎ, অনন্তর পশুবিভাগ, পশুর বিভাগের বিষয় বলিব। জিহ্বাসহিত হনুদ্বয় প্রস্তোতার ভাগ; শ্যেনাকৃতি বক্ষ উদ্গাতার; কণ্ঠ ও কাকুদ্র প্রতিহর্দার ; দক্ষিণ শ্রোণি হোতার; বাম শ্রোণি ব্রহ্মার; দক্ষিণ সক্থি মৈত্রাবরুণের; বাম সক্থি ব্রহ্মণাচ্ছংসীর; অংশসহিত দক্ষিণ পার্শ্ব অধ্বর্য্যুর; বাম পার্শ্ব উদ্গাতাদিগের; বাম অংস প্রতিপ্রস্থাতার; দক্ষিণ দোঃ নেষ্টার; বাম দোঃ পোতার; দক্ষিণ উরু অচ্ছাবাকের; বাম উরু অগ্নাধ্রেয়ের; দক্ষিণ বাহু আত্রেয়ের; বামবাহু সদস্যের; সদ ও অনূক গৃহপতির; দক্ষিণ পদদ্বয় গৃহপতির ব্রতদাতার। ওষ্ঠ উভয় ব্রতদাতার সাধারণ ভাগ; গৃহপতি উহা (দুইজনকে) বিভাগ করিয়া দিবেন। জঘনী পত্নীদিগকে দেওয়া হয়; পত্নীরা তাহা কোনো ব্রাহ্মণকে দান করিবেন। স্কন্ধস্থিত মণিকা ও তিনখানি কীকস গ্রাবস্তুতের; (অন্য পার্শ্বের আর তিন খানি কীকস ও বৈকর্ত্তের অর্ধেক উন্নেতার; বৈকর্ত্তের অপরার্ধ ও ক্লোম শমিতার। শমিতা অব্রাহ্মণ হইলে ঐ ভাগ কোনো ব্রাহ্মণকে দান করিবে। মস্তক সুব্রহ্মণ্যাকে দিবে। “শ্ব সুত্যাং” এই নিগদ যিনি পাঠ করেন, সেই আগ্নীধ্রের ভাগ অজিন। আর সবনীয় পশুর যে ইড়াভাগ হইবে, তাহা সর্ব সাধারণের বা একাকী হোতার। এক এক পদে অভিহিত ঐ অবয়বগুলি এইরূপে ছত্রিশটি ভাগে পরিণত হইয়া যজ্ঞ নির্বাহ করে। বৃহতীর ছত্রিশ অক্ষর; স্বর্গলোক বৃহতীর সম্বন্ধযুক্ত , এতদ্বারা প্রাণ ও স্বর্গলোক লাভ করা যায় এবং এতদ্বারা প্রাণে ও স্বর্গালোকে প্রতিষ্ঠিত হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান হয়। যাহারা পশুকে এইরূপে বিভাগ করেন তাহাদের পক্ষে সেই পশু স্বর্গের অনুকূল হয়। যাহারা অন্য কোনোরূপে পশুবিভাগ করেন, তাহারা অন্ন কামুক (উদরপরায়ণ) পাপকারীর মত কেবল পশুহত্যা করে কেবল। পশুবিভাগের এই বিধি শ্রুতের পুত্র দেবভাগ নামক ঋষি জানিতেন; তিনি কাহারো নিকট ইহা প্রকাশ না করিয়াই ইহলোক হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। কোনো অমনুষ্য উহা বভ্রুর পুত্র গিরিজকে বলিয়াছিলেন, তাহার পরবর্তী মনুষ্যেরা তদবধি উহা জানিয়া আসিতেছে। ( অনুবাদঃ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) অশ্বকে কাটার সময় ছেদক (পুরোহিত বা কসাই) এর হাতে , নখে যে মাংস লেগে থাকতো, সেগুলো দেবতাদের অর্পণ করা হত। কিছু মাংস রান্না করা হত এবং কিছু মাংস শূলে ঝলসানো হত। আশেপাশের লোকজন সেই গন্ধের প্রশংসা করতেন। এ সম্বন্ধে ঋগবেদের নিম্নলিখিত মন্ত্রটি পড়া যেতে পারেঃ এষ ছাগঃ পুরো অশ্বেন বাজিনা পুষ্ণে ভাগো নীয়তে বিশ্বদেব্যঃ। অভিপ্রিয়ং যত্ পুরোলোশমর্বতা ত্বষ্টেদেনং সোশ্রবসায় জিন্বতি।। – ঋগবেদ ১/১৬২/৩ অর্থাৎ, সকল দেবতার উপযুক্ত ছাগ পূষারই ভাগে পড়ে, একে দ্রুতগতি অশ্বের সাথে সম্মুখে আনা হচ্ছে। অতএব ত্বষ্টা দেবতাগণের সুভোজনের নিমিত্ত অশ্বের সাথে ঐ অজ হতে সুখাদ্য পুরোডাশ প্রস্তত করুন। যদশ্বস্য ক্রবিষো মক্ষিকাশ যদ্বা স্বরৌ স্বধিতৌ রিপ্তমস্তি। যদ্ হস্তয়ৌঃ শামিতুর্যন্নখেষু সর্বা তা তে অপি দেবেষ্বস্তু।। – ঋগবেদ ১/১৬২/৯ অর্থাৎ, অশ্বের অপক্ক মাংসের যে অংশ মক্ষিকা ভক্ষণ করে, ছেদনকালে বা পরিস্কার করবার সময় ছেদন ও পরিস্কার সাধন অস্ত্রে যা লিপ্ত হয় , ছেদকের হস্তদ্বয়ে এবং নখে যা লিপ্ত থাকে, সে সমস্তই দেবগণের নিকট যাক। দেবতাদের নামে যদুবধ্যমুদরস্যাপবাতি য আমস্য ক্রবিষো গন্ধো অস্তি। সুকৃতা তচ্ছমিতারঃ কৃণ্বন্তুত মেধং শৃ্তপাকং পচন্তু।। – ঋগবেদ ১/১৬২/১০ অর্থাৎ, উদরের অজীর্ণ তৃণ বের হয়ে যায়, অপক্ক মাংসের যে লেশমাত্র থাকে, ছেদনকর্তা তা নির্দোষ করুন এবং পবিত্র মাংস দেবতাগণের উপযোগী করে পাক করুন। যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানাদভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি। মা তদ্ ভুম্যামা শ্রিষন্মা তৃণেষু দেবেভ্যস্তদুশদ্ভ্যো রাতমস্তু।। – ঋগবেদ ১/১৬২/১১ অর্থাৎ, হে অশ্ব, অগ্নিতে পাক করবার সময়, তোমার গাত্র হতে যে রস বের হয় এবং যে অংশ শূলে আবদ্ধ থাকে তা যেন ভূমিতে পড়ে না থাকে এবং তৃণের সাথে মিশ্রিত না হয়। দেবতারা লালায়িত হয়েছেন, সমস্তই তাদের প্রদান করা হউক। যে বাজিনং পরিপশ্যন্তি পক্বং যে ইমাহুঃ সুরভির্নির্হরেতি। যে চার্বতো মাংসভিক্ষামুপাসত উতো নেষামভিগুর্তির্ন ইন্বতু।। – ঋগবেদ ১/১৬২/১২ অর্থাৎ, যারা চারিদিক হতে অশ্বের পাক দর্শন করে, যারা বলে এর গন্ধ মনোহর হয়েছে, এখন নামাও এবং যারা মাংস ভিক্ষার জন্য অপেক্ষা করে, তাদের সংকল্প আমাদের সংকল্প হোক। এভাবে ঘোড়াকে কেটে, রান্না করেও বলা হত ঘোড়া মরে নি, সে স্বর্গে দেবতাদের কাছে গিয়েছেঃ ন বা উ এতন্ ম্রিয়সে ন রিষ্যসি দেবাং ইদেষি পথিভিঃ সুগেভিঃ – ঋগবেদ ১/১৬২/২১ অর্থাৎ, হে অশ্ব! তুমি মরছ না অথবা লোকে তোমার হিংসা করছে না, তুমি উত্তম পথে দেবতাগণের নিকট যাচ্ছ। সব কিছু সমাপ্ত করে ঘোড়ার কাছে অর্থাৎ অশ্বমেধ থেকে ধন, পুত্র এবং শারীরিক বলের কামনা করা হতঃ সুগব্যং তো বাজী স্বশ্ব্যং পুংসঃ পুত্রান্ উত বিশ্বাপুষং রয়িম্। অনাগাস্ত্বং ত অদিতিঃ কৃণোতু ক্ষত্রং তো অশ্বা বনতাং হবিষ্মান্।। – ঋগবেদ ১/১৬২/২২ অর্থাৎ, এ অশ্ব, আমাদের গো ও অশ্ববিশিষ্ট জগৎপোষক ধন প্রদান করুক, আমাদের পুরুষ অপত্য দান করুক। তেজস্বী অশ্ব আমাদের পাপ হতে বিরত করুক। হবির্ভূত অশ্ব আমাদের শারীরিক বল প্রদান করুক। এই যজ্ঞে অনেক দান করা হত, প্রথম এবং শেষ দিনে এক হাজার গরু এবং দ্বিতীয় দিন রাজ্যের কোনো এক জেলায় বসবাসকারী সকল অব্রাহ্মণদের সম্পত্তি দানে দেওয়ার বিধান ছিল। বিজীত দেশের পূর্ব ভাগের সম্পত্তি ‘হোতা’র , উত্তর ভাগ উদ্গাতার, পশ্চিম ভাগ অধ্বর্যুর ,দক্ষিণ ভাগ ব্রহ্মা এবং তাদের সহায়কদের দেওয়ার বিধান ছিল। যদি এত দান করা সম্ভব না হত , তাহলে চার পুরোহিতকে ৪৮ হাজার গরু, প্রধান পুরোহিত এর তিন সহায়ককে ২৪ হাজার, ১২ হাজার এবং ৬ হাজার গরু দেওয়া হত। (দেখুন ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাস, ১, পৃষ্ঠা ৫৬৯) বাল্মীকি রামায়ণে দশরথের করা অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ যায়। বালকাণ্ডে পাওয়া যায় যে, তিনি এই যজ্ঞ পুত্রের কামনায় করেছিলেন। এক বছর পর্যন্ত ঘোড়াকে ঘোরানোর পর তাকে ফেরত আনা হয়েছিল এবং সরযূ নদীর তীরে যজ্ঞ শুরু করা হয়েছিলঃ অথ সংবৎসরে পূর্ণে তস্মিন্ প্রাপ্তে তুরংগমে। সরয়্বাশ্চোত্তরে তীরে রাজ্ঞো যজ্ঞোহভ্যবর্তন।। ১ ঋষ্যশৃংগং পুরস্কৃত্য কর্ম চক্রুর্দ্বিজর্ষভাঃ। অশ্বমেধে মহাযজ্ঞে রাজ্ঞোস্তস্য সুমহাত্মনঃ।। ২ নিযুক্তাস্তত্র পশাবস্তত্তদুদি্দশ্য দৈবতম্। উরগা পক্ষিণশ্চৈব যথাশাস্ত্রং প্রচোদিতাঃ।।৩০ শামিত্রে তু হযস্তত্র তথা জলচরাশ্চ যে। ঋষিভিঃ সর্বমেবৈতন্নিযুক্তং শাস্ত্রতস্তদা।। ৩১ পশুনাং ত্রিশতং তত্র যুপেষু নিয়তং তদা। অশ্বরত্নোত্তমং তত্র রাজ্ঞো দশরথস্য চ।। ৩২ কৌসল্যা তং হয়ং তত্র পরিচর্য সমন্ততঃ। কৃপাণৌর্বিশশাসৈনং ত্রিভিঃ পরময়া মুদা।। ৩৩ পত্রত্ত্রিণা তথা সার্ধং সুস্থিতেন চ চেতসা। অবসদ্ রজনীমেকাং কৌসল্যা ধর্মকাম্যয়া।। ৩৪ হোতাধ্বর্যুস্তথোদ্গাতা হয়েন সমযোজয়ন্। মহিষ্যা পরিবৃত্ত্যাথ বাবাতামপরাং তথা।। ৩৫ পতত্ত্রিণস্তস্য বপামুদ্ধৃত্য নিয়তেন্দ্রিয়ঃ। ঋত্বিক্পরমসম্পন্নঃ শ্রপয়ামাস শাস্ত্রতঃ।। ৩৬ ধুমগন্ধং বপায়াস্তু জিঘ্রতি স্ম নরাধিপ। যথাকালং যথান্যায়ং নির্ণুদন্ পাপমাত্মনঃ।। ৩৭ হয়স্য যানি চাংগানি তানি সর্বাণি ব্রাহ্মণাঃ। অগ্নৌ প্রাপ্স্যন্তি বিধিবত্ সমস্তাঃ ষোড়শর্ত্বিজঃ।। ৩৮ (বালকাণ্ড, সর্গ ১৪) অর্থাৎ, তারপরে এক বছর সম্পন্ন হলে ঘোড়া ফিরে এল এবং সরযূ নদীর উত্তর তীরে রাজার যজ্ঞ আরম্ভ হল। (১) মহাত্মা রাজা (দশরথ)র অশ্বমেধ নামক মহাযজ্ঞে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ ঋষ্যশৃঙ্গ কে নিজেদের প্রধান বানিয়ে যজ্ঞকর্ম করতে লাগলেন। (২) … পশু, পক্ষী এবং সাপ, যাদের রাখার অনুমতি শাস্ত্র দেয় তাদের অধিষ্ঠাতা দেবতাদের নামে সেখানে রাখা হল। (৩০) ঋষিরা যজ্ঞে বধ করার জন্য ঘোড়া এবং জলচর প্রাণীদের যূপের সাথে বাধলেন। (৩১) সেই যজ্ঞে তিনশত পশু যূপের সাথে বাঁধা হয়েছিল।রাজা দশরথের সেই শ্রেষ্ঠ ঘোড়াকেও ( যে পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরে এসেছিল) বাঁধা হয়েছিল। কৌশল্যা খুশিমনে অশ্বের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে তলোয়ারের তিন কোপে তাকে হত্যা করেছিলেন। (৩৩) কৌশল্যা ঐ মৃত ঘোড়ার পাশে সাবধানচিত্ত হয়ে ধর্মের কামনা করে এক রাত অবস্থান করেছিলেন। (৩৪) তারপর হোতা, অধ্বর্যু এবং উদগাতা মহিষী (যে রানির রাজার সাথে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল), পরিবৃত্তি (রাজার শূদ্র জাতীয় পত্নী) এবং বাবাতা (রাজার বৈশ্য জাতীয় পত্নী) এই তিন শ্রেণীর রানিদের ঘোড়ার সাথে যুক্ত করেছিলেন। (৩৫) জিতেন্দ্রিয় এবং শ্রৌতকর্মে কুশল ঋত্বিক (পুরোহিত) ঐ ঘোড়ার চর্বি বের করেছিল এবং শাস্ত্রানুসারে তা রান্না করেছিল। (৩৬) রাজা দশরথ সেই হবনকৃত চর্বির গন্ধ উপযুক্ত সময়ে বিধান অনুসারে শুঁকেছিলেন, যার ফলে তার পাপ দূর হয়ে গিয়েছিল। (৩৭) ষোল জন ঋত্বিক ব্রাহ্মণেরা মিলে ওই ঘোড়ার যত অঙ্গ ছিল, সব গুলোকে অগ্নিতে হবন করেছিলেন। মহাভারতে অশ্বমেধ মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, অশ্বমেধের ফলে সমস্ত পাপ দূর হয়ে যায়। মহাভারতের যুদ্ধে বিশাল নরসংহারের ফলে পাণ্ডবদের যে পাপ হয়েছিল, সেই পাপ দূর করার জন্য যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞে তিনশ পশুর বলি দেওয়া হয়েছিল এবং ঘোড়ার চর্বি দিয়ে আহুতি দেওয়া হয়েছিল। যজস্ব বাজিমেধেন বিধিবত্ দক্ষিণাবতা।। ১৫ অশ্বমেধো হি রাজেন্দ্র পাবনঃ সর্বপাপ্মনাম্। তেনেষ্ট্বা ত্বং বিপাপ্মা বৈ ভবিতা নাত্র সংশয়ঃ।। ১৬ (অশ্বমেধিকপর্ব, অধ্যায় ৭১) অর্থাৎ, ব্যাস বলেছেন, “ হে যুধিষ্ঠির, বিধি পূর্বক দক্ষিণা দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান কর। রাজেন্দ্র, অশ্বমেধ যজ্ঞ সমস্ত পাপ নাশ করে যজমানকে পবিত্র করে। এর অনুষ্ঠান করে তুমি পাপমুক্ত হবে, এতে সংশয় নেই।“ ততো নিযুক্তাঃ পশবো যথাশাস্ত্রং মনীষিভিঃ। তং তং দেবং সমুদ্দিশ্য পক্ষিণঃ পশবশ্ব যে।। ঋষভাঃ শাস্ত্রপঠিতাস্তথা জলচরাশ্চ যে। সর্বাস্তানভ্যযুংজংস্তে তত্রাগ্নিচযকর্মণি।। যুপেষু নিয়তা চাসীত্ পশুনাং ত্রিশতী তথা। অশ্বরত্নোত্তরা যজ্ঞে কৌন্তেয়স্য মহাত্মনঃ।। (অশ্বমেধিকপর্ব ৮৮/৩৩-৩৫) অর্থাৎ, এরপর মনিষী ঋত্বিকেরা শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে পশুদের নিযুক্ত করলেন। ভিন্নভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু, পাখি এবং শাস্ত্রকথিত বৃষভ এবং জলচর জন্তু- এদের অগ্নিস্থাপন কার্যে যাজকেরা ব্যবহার করলেন। কুন্তীনন্দন মহাত্মা যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞে যে সব যূপ দাঁড় করানো হয়েছিল, তাতে তিনশত পশু বাঁধা হয়েছিল। এসবের মধ্যে প্রধান সেই অশ্বরত্ন ছিল। (মহাভারত, খণ্ড ৬, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর, হিন্দি অনুবাদ সহিত, পৃষ্ঠা ৬২৯০) শ্রপয়িত্বা পশুনন্যান্ বিধিবদ্ দ্বিজসত্তমাঃ। তং তুরংগং যথাশাস্ত্রমালভন্ত দ্বিজাতয়ঃ।। ১ ততঃ সংশ্রপ্য তুরংগং বিধিবদ্ যাজকাস্তদা। উপসংবেশয়ন্ রাজংস্ততস্তাং দ্রুপদাত্মজাম্।। ২ উদ্ধৃত্য তু বপাং তস্য যথাশাস্ত্রং দ্বিজাতয়ঃ।। ৩ শ্রপয়ামাসুরব্যগ্রা বিধিবদ্ ভরতর্ষভ। তং বপাধুমগন্ধং তু ধর্মরাজঃ সহানুজৈঃ।। ৪ উপাজিঘ্রদ্ যথাশাস্ত্রং সর্বপাপাহং তদা। শিষ্টান্যংগানি যান্যাসংস্তস্যাশ্বস্য নরাধিপ।। ৫ তান্যগ্নৌ জুহুবুর্ধীরাঃ সমস্তাঃ ষোড়শর্ত্বিজঃ।। ৬ ( অশ্বমেধিক পর্ব ৮৯ ) অর্থাৎ, সেই শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা অন্যান্য পশুদের বিধিপূর্বক রান্না করে ওই অশ্বকেও শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে বধ করলেন। (১) রাজন, তারপর যাজকেরা বিধিপূর্বক অশ্বকে রান্না করে তার কাছে দ্রৌপদীকে শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে বসালেন। (২) হে ভরতশ্রেষ্ঠ, তারপর ব্রাহ্মণেরা শান্তচিত্ত হয়ে সেই অশ্বের চর্বি বের করে তাকে বিধিপূর্বক রন্ধন করা শুরু করলেন। (৩) ভাইদের সাথে যুধিষ্ঠির শাস্ত্রোক্ত আজ্ঞা অনুসারে সমস্ত পাপনাশক সেই চর্বির ধোয়ার গন্ধ শুঁকেছিলেন। (৪) নরেশ্বর, ওই অশ্বের যে শেষ অঙ্গ ছিল তা দিয়ে শান্ত স্বভাবের সমস্ত ষোল জন ঋত্বিকেরা অগ্নিতে হোম করেছিলেন। (৫) (মহাভারত, ষষ্ঠ খণ্ড, গীতাপ্রেস, গোরখপুর, হিন্দি অনুবাদ সহিত, পৃষ্ঠা ৬২৯০-৬১৯১) এটা স্পষ্ট যে, অশ্বমেধ যজ্ঞে প্রচুর হত্যাকাণ্ডের বিধান ছিল। এইজন্য অনেক লোকেরা আজ এসবে লজ্জিত হয়ে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্মের উপর পর্দা দেওয়ার জন্য অনেক রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করে, চার মধ্যে চার রকমের পদ্ধতি অন্যতম। প্রথমটি হল- বামমার্গীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো। বলা হয় বামমার্গীরা আমাদের ধর্মগ্রন্থে এই ধরণের ভ্রান্ত কথা মিশিয়েছিল। এই কথাটি একেবারেই শিশুসুলভ। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে বামমার্গীরা নিজেদের কাছে থাকা সেইসব গ্রন্থে তো নিজেদের কথা মেশাতে পারে , কিন্তু হিন্দুদের ঘরে এবং মঠে সুরক্ষিত থাকা পুঁথিতে তারা কিভাবে নিজেদের কথা মেশালো? আজ যতগুলো কপি পাওয়া যায়, এর সবকটিতে এই কথাগুলো আছে। সব কপিই কি তাহলে বামমার্গীদের কাছে ছিল? তখন হিন্দুরা কি করছিল? তাদের কাছে নিজেদের গ্রন্থের একটি কপিও কেন ছিল না? দ্বিতিয়ত, শতাব্দীর পর শতাব্দী কোনো হিন্দু, বিদ্বান, ধর্মগুরু অথবা আচার্যরা কেন এইসব কথাকে বামমার্গীদের মেশানো বলে দাবী করেননি? প্রাচীন সময়ের বুদ্ধিবাদীরা সময়ে সময়ে এইসব অনর্থক প্রথার উপর আক্রমণ করেছিলেন। সর্বদর্শনসংগ্রহে (১৪ শতাব্দী) উদ্ধৃত একটি শ্লোকে বলা হয়েছেঃ অশ্বস্যাত্র হি শিশ্নং তু পত্নীগ্রাহয়ং প্রকীর্তিতম্। ভংডৈস্তদ্বদ্ পরং চৈব গ্রাহয়জানং প্রকীর্তিতম্।। অর্থাৎ, ভাঁড়েরা বলে, পত্নীদের ঘোড়ার লিঙ্গ গ্রহণ করা উচিত। তারা লিখেছেন, এভাবে অনেক কিছুই গ্রহণ করার যোগ্য। সেই যুগে যখন এমন যজ্ঞ প্রায়শই হত, বুদ্ধিবাদীরা এইধরণের বিধান দেওয়া ‘ ঐশ্বরিক’ বেদকে প্রতারকদের বাণী বলে অভিহিত করেছিলেন এবং কেউ তাদের এর উত্তর প্রদান করেননি। তখন থেকে এখন পর্যন্ত, শতাব্দী ধরে অনেক বড় বড় গ্রন্থ লেখা হয়েছে কিন্তু এই শ্লোকের কোনো উত্তর কেউ দেয়নি। মহীধর যজুর্বেদের ভাষ্য পরে লিখেছিলেন। যদি বুদ্ধিবাদীদের কথা মিথ্যে হত তাহলে তিনি নিজের বেদভাষ্যে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারতেন কিন্তু তিনি নিজেও একই কথা লিখেছিলেন। সমগ্র হিন্দু ধার্মিক সাহিত্যের কোথাও অশ্বমেধের হিংসা, অশ্লীলতা এবং অনর্থক কথাগুলোকে অস্বীকার করা হয়নি, এগুলোকে বামমার্গীদের কথা বলেও অভিহিত করা হয় নি। আধুনিককালে যারা বামমার্গীদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন, তাদের কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। স্পষ্টতই, হিন্দুরাই এইসব গ্রন্থ লিখেছিল, বামমার্গীরা এসবে কোনো কথা মেশায়নি।আজকে এসবকে আড়াল করার যে চেষ্টা চলছে, এর কারণ বর্তমান সভ্যতার আদিম ধর্মসংস্কারগুলো নিয়ে লজ্জা এবং এর প্রতিপাদক ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থকে মোহবশত আঁকড়ে ধরে থাকার মনোবৃত্তি ।এর শিকার যে সব ব্যক্তি , তারা কোনো ভিত্তি ছাড়াই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থকে পবিত্র এবং শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে থাকে। না পড়েই তারা যেহেতু এই মত পোষণ করে থাকে, তাই যখন প্রাচীন আপত্তিকর কথা তারা প্রমাণ সহ দেখতে পায় , তখন তারা এর জন্য বিধর্মীদের দোষারোপ করে নিজেদের মান বাঁচাতে চায় এবং ধর্মগ্রন্থকে নির্দোষ দেখাতে চায়। কিন্তু এতো আসলে কাঠের হাঁড়ি, একে উনুনে একবারও চড়ানো যায় না, বার বার চড়ানো তো দূরের কথা। এই প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ আর্যসমাজী বিদ্বান যুধিষ্ঠির মীমাংসক তার মীমাংসাশাবরভাষ্যের টীকায় যা বলেছেন তা দ্রষ্টব্যঃ “ঐতরেয় ব্রাহ্মণে হত্যা করা পশুর মাংসের বিভাগ থেকে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট যে ,ঐতরেয়ের মূল প্রবচন কালে অথবা শৌনক দ্বারা এর পুনঃসংস্কারের কালে যজ্ঞে পশুবলি হত এবং ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞশিষ্ট প্রসাদরূপ মাংসের ভক্ষণ করতো অথবা এই পশুবলি এবং যজ্ঞীয়মাংসশেষ এর ভক্ষণ উত্তরকালে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রক্ষীপ্ত মনে করার মত কোনো সুদৃঢ় প্রমাণ নেই।“ ( মীমাংসাশাবরভাষ্যম, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১০৭৫) দ্বিতীয় পদ্ধতি হল শব্দের অর্থ বদল। বলা হয়ে থাকে, অশ্বমেধে যে ‘অশ্ব’ শব্দ রয়েছে, এর অর্থ ঘোড়া নয় বরং অশ্বগন্ধা নামক গাছ।সেই গাছই অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় হবনকুন্ডে দেওয়া হত, যার সুগন্ধে দেবতারা প্রসন্ন এবং জীবাণু নষ্ট হয়ে যেত যার ফলে প্রজারা সুস্থ এবং সুখী হয়ে উঠতো। আমাদের প্রশ্ন হল- অশ্বমেধের সময় দিগ্বিজয়ের জন্য রাজারা সৈনিকদের তত্ত্বাবধানে যে ‘অশ্বকে’ ছাড়তেন, সেটাও কি ঘোড়া নয়, অশ্বগন্ধা নামক লতা ছিল, যাকে কোনো চাকরেরর মাথার উপরের ঝুড়িতে রেখে এক বছর ঘোরনো হত? যদি সেটা গাছই হত, তাহলে তাকে খাম্বায় বেঁধে তলোয়ার দিয়ে কেন কাটা হত? তাকে কি সরাসরি উঠিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করা যেত না? তারপর ব্রাহ্মণগ্রন্থে ‘অশ্বের’ ছত্রিশটি টুকড়ো করার বিধান রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে চোয়াল কাকে দিতে হবে, হাত কাকে দিতে হবে, লেজ কার জন্য, উপরের ঠোঁট কার জন্য, ঘাড়ের অংশ কার। এসব অঙ্গ কি একটি গাছের থাকতে পারে? আবার যজুর্বেদের মন্ত্রে তো পটরানীর দ্বারা ঘোড়ার বীর্য নিক্ষেপকারী লিঙ্গকে টেনে নিজের যোনিতে প্রবেশ করানোর বিধান রয়েছে। অশ্বগন্ধা গাছেরও কি লিঙ্গ আছে, সেও কি বীর্য ছাড়তে পারে? যেমনটা প্রথমে লিখেছিলাম, প্রাচীন বুদ্ধিবাদীরা পটরানীর ঘোড়ার লিঙ্গ গ্রহণের নিন্দা করেছিলেন। যদি অশ্ব এর জায়গায় অশ্বগন্ধার অশ্বমেধ করা হত, তাহলে বুদ্ধিবাদীরা ‘পত্নীর ঘোড়ার লিঙ্গ গ্রহণের বিধানকে’ কেন আক্রমণ করতেন? এর কি প্রয়োজন ছিল? তাহলে তো প্রত্যেকে বলতে পারতো- তুমি কি ‘অশ্ব’ দেখতে পাচ্ছ? অশ্বগন্ধা গাছ কি দেখতে পাচ্ছ না? গাছেরও কি লিঙ্গ আছে, যেটা পত্নী গ্রহণ করতে পারে? কিন্তু এমন উত্তর সমগ্র হিন্দু সাহিত্যে, এখনকার কিছু গোঁজামিলবাজদের লেখা ছাড়া, কোথাও পাওয়া যায় না। স্বামী করপাত্রীজী মহারাজ তো গাছ হওয়ার সমস্ত রকমের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে যজ্ঞে পশুহত্যার কথা বলেছেন এবং তাদের মৃত্যুকে তাদের জন্য লাভদায়ক বলে লিখেছেন, “যজ্ঞে করা পশুবধ পশুদের স্বর্গে নিয়ে যায় এবং তারা পশুযোনি ত্যাগ করে দিব্য শরীর লাভ করে, ফলে পশুর উপকারই হয়ে থাকে। … সেই যজ্ঞীয় পশুরা অপকৃষ্ট যোনি থেকে মুক্ত হয়ে দেবযোনিতে জন্মগ্রহণ করে।“ (বেদার্থপরিজাত, ভাগ ২, পৃষ্ঠা ১৯৭৭-১৯৭৮) দ্বিতীয়ত, আপস্তম্ভ কল্পসূত্রে বলা হয়েছেঃ অশ্বালম্ভ্যং গবালম্ভং সংন্যাসং পলপৈতৃকম। দেবরাচ্চ সুতোত্পত্তিঃ কলৌ পঞ্চ বিবর্জ্জয়েত্।। অর্থাৎ, অশ্বমেধ, গোমেধ, সন্ন্যাস, শ্রাদ্ধে মাংস প্রদান করা এবং দেবর দ্বারা নিয়োগের মাধ্যমে পুত্র উৎপন্ন করা- এই পাঁচ জিনিস কলিযুগে করা উচিত নয়। এভাবেই বৃহন্নারদীয় পুরাণে বলা হয়েছেঃ নরমেধাশ্বমেধকৌ গোমেধমখং তথা ইমান্। ধর্ম্মান কলিযুগে বর্জ্যানাহুঃ মনীষিণঃ।। অর্থাৎ, নরমেধ, অশ্বমেধ তথা গোমেধ যজ্ঞ- এসব ধর্মকার্যকে বিদ্বানেরা কলিযুগে নিষিদ্ধ বলেছেন। অশ্বমেধে যদি অশ্বের অর্থ ঘোড়া না হয়ে গাছ হত তাহলে এসব অর্বাচীন গ্রন্থে কলিযুগে এদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কি প্রয়োজন ছিল? এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হল বৌদ্ধরা যজ্ঞে হওয়া অনর্থক হিংসার তীব্র বিরোধীতা করেছিল। এরই ফলে যজ্ঞের ওকালতি করা পুরোহিতদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের এসব যজ্ঞের নিন্দা করতেই হয়েছিল। তৃতীয় যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তা খুবই বিচিত্র। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সাথী পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা , যিনি পরবর্তীকালে সনাতন ধর্মের নেতা হয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন “ বেদভাষ্যকার মহীধরের লেখা অনুসারে এইসব মন্ত্রের অর্থ কাউকে সংস্কৃত এবং লোকভাষাতে কোনো যজ্ঞের সময় এবং অন্যত্র বলা উচিত নয়… মহীধরেরও এমন অভিপ্রায় কখনোই ছিল না যে , যজ্ঞের সময় এবং অন্যত্র এই অর্থ বলা হোক… কিন্তু মহীধরেরও এই মত যে, এমন অর্থ কোথাও বলার যোগ্য নয়। কেবল বেদাধিকারী শুদ্ধ পুরুষ ওই মন্ত্রের অর্থ জানতে চাইলে এই সংস্কৃত ভাষ্য থেকে তারা জানতে পারেন। … যেহেতু এই অর্থ অবাচ্য (বলার অযোগ্য) তাই একে বলা আমিও উচিত মনে করি না কিন্তু যজ্ঞ এবং স্বাধ্যায় প্রভৃতির সময় কেবল মন্ত্র বাচ্য (পড়া এবং বলার যোগ্য) ” ( পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা, আশ্বমেধিকমন্ত্রমীমাংসা (১৯১১ ইং) , পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯) মানে তারা বলছেন, অর্থ তো ঠিক আছে, কিন্তু এই অর্থ বলা উচিত নয়, কেবল মন্ত্রটি তোতার মত পড়া উচিত। অর্থকে কেবল বেদাধিকারী বিদ্বান নিজের স্বাধ্যায় এর জন্য পড়তে পারেন, তবে কাউকে বলার জন্য নয়। এর থেকে একটি কথা তো স্পষ্ট হয়ে যায় অশ্বমেধে হত্যাকাণ্ড এবং অশ্লীল কর্ম হওয়ার কথা তো এরাও স্বীকার করে, কিন্তু জনসাধারণ এর অর্থ জানুক, তারা এটা চায় না, কেননা তারা যদি এসব জেনে যায় তাহলে তাদের বেদশাস্ত্র থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে। তাহলে এসবের নামে যেসব ব্যবসা চলছে সেসব কিভাবে চলবে? এখানে পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা এইসব অর্থ বলা,শোনায় নিষেধ করে এটা তো স্বীকার করে নিয়েছেন, যা অর্থ করা হয়েছে তা তো ঠিকই আছে । উনি কিন্তু এটা বলেননি যে এইসব অর্থ বিধর্মীরা করেছে বা এসব প্রক্ষিপ্ত। এইজন্য প্রাচীন বুদ্ধিবাদীরা বলেছিলেনঃ অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্। বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ থেকে উদ্ধৃত) অর্থাৎ, আচার্য বৃহস্পতি বলেছেন, অগ্নিহোত্র আদি যজ্ঞ, তিন বেদ, ত্রিদণ্ড, শরীরের ভস্ম মাখা এসব বুদ্ধি এবং পৌরুষহীন লোকেদের জীবিকার উপায়। চতুর্থ পদ্ধতি হল- ছদ্ম বিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়া। কিছু লোক কপোলকল্পিত বৈদিক বিজ্ঞানের নামে নির্লজ্জতাপূর্বক আজও জঙ্গলিপনাকে সিদ্ধ করে থাকে। এক সনাতনী পণ্ডিত লিখেছেনঃ যাজ্ঞিক অশ্বের রুধির দুধে রূপান্তরিত হয়ে যেত এবং শরীর কর্পূর হয়ে যেত। গর্ভাশয় কে শুদ্ধ করার জন্য অশ্বের কর্পূরে রূপান্তরিত হওয়া চর্বিকে বিধি অনুসারে আগুনে নিক্ষেপ করলে যে ধোঁয়া উঠতো, যজমান পত্নী সেই ধোয়া দিয়ে নিজের গর্ভাশয় লাগাতো। এইজন্য এক রাত যজমান পত্নী একা মৃত অশ্বের কাছে থাকতো। বস্তুত যজমানের পত্নীর গর্ভাশয়ের বিষাক্ত অবস্থাকে দূর করার জন্য এটা একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল।“ (কিউ? (উত্তরার্ধ) পৃষ্ঠা ৮৭৮ এবং ৮৮০) অন্য একজন পণ্ডিত লিখেছেনঃ রানীর গর্ভাশয়কে শুদ্ধ করার জন্য অশ্বমেধের বিশিষ্ট ঘোড়ার পৃথক করা অঙ্গ (অর্থাৎ, কেটে ফেলা লিঙ্গ) থেকে তৈরি করা পদার্থকে রানী নিজের অঙ্গে (নিজের যোনিতে) প্রবেশ করাতো। এর ফলে স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব দোষ দূর হয়ে যেত। আবার ওই অশ্বের অঙ্গ হবন করার ফলে- তা মন্ত্রের শক্তি দ্বারা অদ্ভুত শক্তিযুক্ত এবং সুগন্ধযুক্ত হয়ে যেত। এই সূক্ষ্ম অঙ্গের গন্ধ রাজা-রানীর শোঁকার ফলে তা তাদের ভিতরে প্রবেশ করার ফলে তাদের শুক্র এবং যোনির দোষ দূর হত। (শ্রীসনাতনধর্মশ্লোক, ভাগ ৬, পৃষ্ঠা ৪১০-৪১১) এসব ব্যাখ্যা মিথ্যা বিজ্ঞানের মোড়কে জঙ্গলিপনাকে পরিবেশন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের নাম নিয়ে লোকজনকে নিজেদের জালে ফাঁসানো। এর জন্যই দুইজন পণ্ডিতের কল্পিত এবং নির্লজ্জ ব্যাখ্যার একটি অন্যটির সাথে মেলে না। একজন বলছেন, মন্ত্রের প্রভাবে ঘোড়ার অঙ্গ যখন কর্পূরে রূপান্তরিত হয়ে যেত, তখন তা অগ্নিতে নিক্ষেপ করে অগ্নি থেকে ওঠা ধোঁয়া যজমান পত্নী তার যোনিতে লাগাতো। অন্যদিকে দ্বিতীয়জন বলছেন, ঘোড়ার লিঙ্গ কেটে তৈরি পদার্থ রানী নিজের যোনিতে প্রবেশ করাতো এবং ঘোড়ার অঙ্গ হবন করার ফলে যে ধোঁয়া উঠতো, তা শোঁকার ফলে বীর্য এবং যোনির দোষ দূর হয়ে যেত। এই প্রলাপের ভিত্তি কি? কোন আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থে এই বিধান রয়েছে? সুশ্রুত এটা বলেছেন, না চরক? শুধু তাই নয়, ধার্মিক অজ্ঞতায় পূর্ণ কোনো গ্রন্থেও অশ্বমেধের এই প্রকার লাভের কথা বলা হয় নি যেমনটা বিংশ শতাব্দীতে এসে এইসব মূর্খ বাস্তব আগ্রাহ্যকারীরা বলে চলেছে। তাদের এসব আসলে ব্যাখ্যা হিন্দু ধর্মের শেকড়- বেদের উপরই কুঠারাঘাত। আসলে যে কারণে যজ্ঞে এইসব কর্ম মানুষেরা করতো- আদিম কালে কার্য-কারণ মানুষ খুব কমই জানতো। তাই ‘এই’ ‘ওই’ কার্যের কারণ ‘এটা’ ‘ওটা’ ধরে নেওয়া হত। এইজন্য পাপনাশের জন্য প্রাণীদের হত্যা করা হত। এর পেছনে অজ্ঞানতামূলক স্থূল সাদৃশ্য কাজ করতো, যেমনভাবে গ্রামের প্রধানকে প্রসন্ন করার জন্য উপহার দেওয়া হয়, তেমনি হয়তো দেবতাদের উপহার দিলে দেবতারা প্রসন্ন হয়ে যাবে এবং মনোকামনা পূর্ণ করবে। তখন প্রায়শই খাদ্যকেই উপহার রূপে দেওয়া হত। অন্ন এবং পশু উভয়ই খাদ্য ছিল। যেমন গ্রামপ্রধানকে উপহার দেওয়া প্রত্যেক অন্ন এবং পশু অগ্নিতে ফেলে ঝলসিয়ে খেয়ে ফেলা হত, তেমনি দেবতাদের প্রসন্ন করার জন্য দেওয়া উপহারও অগ্নিতে ফেলা হত। এই ধরণের শিশুসুলভ বিশ্বাসই পশুযজ্ঞের সারকথা। এই শিশুসুলভ বিশ্বাসের অধীন হয়ে পটরানীর ঘোড়ার সাথে সঙ্গম করানো হত- এই ভেবে যে ঘোড়ার সমান শক্তিশালী পুত্রের জন্ম হবে। দেখুন শতপথব্রাহ্মণে (১৩/১/৯/৯) বলা হয়েছে, অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ফলে বাহাদুর পুত্রের জন্ম হয়। যখন মৈথুনের এই প্রক্রিয়া সর্বসমক্ষে চলত তখন পুরোহিতেরা বয়ে চলা গঙ্গায় হাত ধোয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত অন্যান্য নারীদের সাথে মোখিক কামতৃপ্তিতে লিপ্ত হত। স্বার্থপর লোকেরা পরবর্তীকালেও এইসব অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়াতেই নিজেদের সুবিধা দেখেছিল। এইজন্য নানারকমের পূণ্য, ‘পরলোক’ এর প্রলোভন প্রভৃতির ঘোষণা করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের পূর্বপুরুষের প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসাকে কাজে লাগিয়ে তাদের নামে যজ্ঞের মাহাত্ম্য সূচক বাক্য নিজেদের পুঁথিতে ঢুকিয়েছিল অথবা নিজেদের পুঁথিগুলোকে ওই পূর্বপুরুষদের রচনা বলে প্রচার করেছিল।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা

















No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ